মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়: বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়

ছোট মন্ত্রণালয় হয়েও বড় বিতর্কে জড়িয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এই মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের আবেগ-অনুভূতি এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জড়িত। কিন্তু প্রতিষ্ঠার সাড়ে ১৮ বছরে মন্ত্রণালয়টি যে কাজেই হাত দিয়েছে, নতুন নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।

প্রথমে মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন তালিকা করতে গিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে মন্ত্রণালয়। সর্বশেষ রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলে। এর আগে বিদেশি বন্ধুদের সম্মান জানাতে গিয়ে ক্রেস্ট নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্থাপনা ও বধ্যভূমি সংরক্ষণসহ নানা বিষয়ে একের পর এক প্রকল্প নিলেও সেগুলো বাস্তবায়ন করতে পারছে না। অসচ্ছল ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তৈরি করা বীর নিবাস, মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ারসহ যেসব প্রকল্প শেষ করেছে, সেগুলোর মান, বরাদ্দ ও তদারকি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যাত্রা শুরু হয় ২০০১ সালের ২৩ অক্টোবর বিএনপি আমলে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে এই মন্ত্রণালয় গতি পেলেও মূল কাজ নিয়ে তেমন এগোতে পারেনি।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক মেজর (অব.) এ এস এম শামসুল আরেফিন প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোনো গবেষণা না হওয়ার বিষয়টি দুঃখজনক। আর মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ দলিল সংগ্রহের দিকে কারও নজর নেই। অথচ সরকারের জন্য এ কাজগুলো তেমন কঠিন নয়। সরকারের উচিত স্বাধীনতার দলিল তৈরিতে কাজ শুরু করা।

মন্ত্রণালয়ের কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সঠিক তালিকা তৈরি ও হালনাগাদ, সম্মানী ভাতা দেওয়া, যুদ্ধাহত ও খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের চিকিৎসা, রেশনসহ বিভিন্ন সুবিধা প্রদান, মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসভিত্তিক দলিল প্রকাশ ও সংরক্ষণ, মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান, যুদ্ধক্ষেত্র, বধ্যভূমি ও গণকবর চিহ্নিত করে সংরক্ষণ, মুক্তিযুদ্ধে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য দেশি-বিদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। অথচ পুরো সময়ে এই মন্ত্রণালয় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা, সংখ্যা ও মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের কাজে বেশি তৎপর থেকেছে।

>

প্রতিষ্ঠার সাড়ে ১৮ বছরে যে কাজেই হাত দিয়েছে, নতুন নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।

কোনো উদ্যোগ বা পরিকল্পনা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন না হওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই। আমরা প্রতিটি কাজ ভালোভাবে সম্পন্ন করার প্রত্যয় নিয়ে শুরু করি। আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। আমলাদের কাছ থেকে পুরোপুরি সহযোগিতাও পাওয়া যায় না। তবে আমরা যেসব উদ্যোগ নিয়েছি, তা অবশ্যই বাস্তবায়ন করব। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সঠিক তালিকাও প্রকাশ করব।’

বিতর্ক শুরু ভুয়া সনদ দিয়ে
জনপ্রশাসনের ছয় সচিব, শীর্ষ কর্মকর্তাসহ প্রায় তিন হাজার ব্যক্তির ভুয়া সনদ নেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হয় ২০১৪ সালে। এঁদের বেশির ভাগই সনদ নিয়েছিলেন ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই। সনদ ভুয়া প্রমাণিত হওয়ার পর তাঁদের বিচার না করে স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষকের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ ছিল। তাঁদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ ব্যাপারে আইনি ও বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন। কিন্তু গত ছয় বছরে কোনো মামলা হয়নি। এ ছাড়া চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা ঘোষণা করেননি, অথচ পরে সনদ নিয়েছেন, এমন অভিযোগ পাওয়া যায় এক সচিবসহ ১৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। তাঁদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

ক্রেস্টের সোনা জালিয়াতি
মহান মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক, শিল্পী-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, বিশিষ্ট নাগরিক ও সংগঠনকে সম্মাননার সময় দেওয়া ক্রেস্টে যে পরিমাণ স্বর্ণ থাকার কথা ছিল, তা ছিল না। আর ক্রেস্টে রুপার বদলে দেওয়া হয় পিতল, তামা ও দস্তামিশ্রিত সংকর ধাতু। ২০১৪ সালের ৬ এপ্রিল প্রথম আলোতে ‘ক্রেস্টের স্বর্ণের ১২ আনাই মিছে!’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এ ঘটনায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠিত প্রথম তদন্ত কমিটি সাবেক প্রতিমন্ত্রী এ বি তাজুল ইসলাম, তৎকালীন সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকীসহ ১৩ কর্মকর্তা ও দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করেছিল। এরপর বিষয়টি আর এগোয়নি। শহীদ পরিবারের সদস্য নাসরিন আহমেদের পক্ষে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ একটি রিটও করেন। ক্রেস্ট সরবরাহকারী দুটি প্রতিষ্ঠানের মালিকের নামে মামলা করে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়। কিন্তু কারও শাস্তি হয়নি।

অধ্যাপক ও গবেষক মুনতাসীর মামুন বলেন, ক্রেস্ট কেলেঙ্কারির ঘটনায় কারও শাস্তি হয়নি বলেই রাজাকারের তালিকা নিয়ে এমন বিতর্ক হলো। তিনি বলেন, আমলানির্ভর এই মন্ত্রণালয়ের প্রধান সমস্যা হলো প্রকল্পে যাঁরা থাকেন, তাঁদের প্রধান উদ্দেশ্যই থাকে বিদেশভ্রমণ।

১১ বছরেও তালিকা হলো না
টানা প্রায় ১১ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করতে পারেনি বর্তমান সরকার। এর আগে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ৭০ হাজারের বেশি লোককে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল, যাঁরা মুক্তিযোদ্ধা নন। এরপর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী তাজুল ইসলাম একইভাবে আরও সাড়ে ১১ হাজার মুক্তিযোদ্ধার সনদ দেন, যা নিয়েও বিতর্ক দেখা দেয়।

২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকঢোল পিটিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া শুরু করে সরকার। নতুন করে প্রায় দেড় লাখ আবেদন জমা পড়ে। এই প্রক্রিয়া নিয়েও অনিয়মের অভিযোগ উঠলে শেষ পর্যন্ত নতুন তালিকা প্রকাশ স্থগিত হয়। যাচাই-বাছাই এখনো চলছে।

সরকারের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সব ধরনের তালিকা মিলে মোট মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৮৫৬ জন। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবি করেন এমন সংখ্যা ২ লাখ ৫১ হাজার ২৮৫। এঁদের অনেকের নাম একাধিক গেজেটে বা দলিলে রয়েছে। বর্তমানে ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখ ১ হাজার ৪৬১ জন।

মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা বারবার পরিবর্তন
২০১০ সালের ৭ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময় যাঁরা নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন অথবা যাঁদের নাম মুক্তিবার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল অথবা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাঁদের নাম গেজেটে প্রকাশিত হয়েছিল অথবা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাঁরা প্রধানমন্ত্রীর সই করা সনদ নিয়েছেন, তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাড়তি এক বছর চাকরি করার সুযোগ পাবেন।

এ নিয়ে বিতর্কের একপর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে দিকনির্দেশনা চেয়ে চিঠি পাঠায়। এতে বলা হয়, চাকরি গ্রহণকালে এবং পরে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেকে ঘোষণা দেননি বা মুক্তিযোদ্ধার কোটায় চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ নেননি, তাঁদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাড়তি সুবিধা দেওয়া হবে কি না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশনা দেন, ‘যাঁরা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, তাঁরা যে অবস্থায়ই হোক, সুবিধা পাবেন।’

ওই সারসংক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে। এতে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া নির্দেশনার উল্লেখ করে বলা হয়, এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের জারি করা ২০১০ সালের ৭ নভেম্বর এবং ২০১১ সালের ৬ মার্চ জারি করা চিঠিতে মুক্তিযোদ্ধা গণকর্মচারীর নির্ণায়ক হিসেবে যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তা অনুসরণ করতে হবে।

২০১৪ সালে পুনরায় জামুকার বৈঠকে মুক্তিযোদ্ধার উপাধি বা সনদ পাওয়ার জন্য আট যোগ্যতার কথা বলা হয়। একই বছর জামুকার আরেক বৈঠকে বলা হয়, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে যেকোনো আবেদনকারীর বয়স ১৯৭১ সালে ন্যূনতম ১৫ বছর হওয়া বাধ্যতামূলক। এই সিদ্ধান্তের পর ১৩ বছর বয়সী শহীদুল ইসলাম, ১৪ বছর বয়সী তারামন বিবি ও আবু সালেকদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির কী হবে, এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

এরপর জামুকার বৈঠকে আবারও সিদ্ধান্ত হয়, একাত্তরের ২৬ মার্চ যাঁদের বয়স ন্যূনতম ১৩ বছর ছিল, তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে পারবেন। পরে দেখা যায়, ১৩ বছরের কম বয়সীদেরও তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।

সর্বশেষ গত বছরের ১৬ জানুয়ারি মন্ত্রণালয় পরিপত্র জারি করে জানায়, একাত্তরের ৩০ নভেম্বরে যেসব মুক্তিযোদ্ধার বয়স ন্যূনতম ১২ বছর ৬ মাস ছিল, তাঁদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এই বয়সসীমা নিয়ে এখনো বিতর্ক চলছে।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ১১ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই তালিকা চূড়ান্ত করতে পারল না, এটা দুর্ভাগ্যজনক। মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের উদাসীনতাই এর একমাত্র কারণ। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নির্ধারণ করতে হলে গবেষক ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে যাচাই-বাছাই করতে হবে। না হলে কখনো একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা হবে না।