ভিন্ন চর্চায় ১৩ বছর

জাপানের রেইকো সিমুজি এবং বাংলাদেশের পলি লায়লার পারফরম্যান্স।  ছবি: লেখক
জাপানের রেইকো সিমুজি এবং বাংলাদেশের পলি লায়লার পারফরম্যান্স। ছবি: লেখক

কুষ্টিয়ার স্মরণ মৎস্যবীজ খামারে গতকাল শেষ হলো ১৩তম ক্র্যাক আন্তর্জাতিক আর্টক্যাম্প। ২০০৭ সাল থেকে প্রতিবছর ২৫ থেকে ৩০ ডিসেম্বর এই আর্টক্যাম্পটি অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে কুষ্টিয়ায়। গতকাল আর্টক্যাম্পের শেষ দিনে এটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় দর্শকদের জন্য। বাংলাদেশসহ ভারত, রাশিয়া ও জাপানের ২১ জন শিল্পী ইনস্টলেশন, পারফরম্যান্স আর্টসহ বিভিন্ন মাধ্যমে তাঁদের শিল্পকর্ম সৃষ্টি করেছিলেন। এবারের ক্যাম্পের কিউরেটর ছিলেন ভারতের শিল্পী অধ্যাপক সুরেশ কে নায়ার। অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা হলেন রেইকো সিমিজু, তামিকো তাকাহাসি, লাভরেনটি রেপিন, আশিস রাঠোর, বালাগোপান বেথুর, সুভাষ কুমার মাসকারা, ঊর্মিলা বানু, শিরিন শেখ, জুয়েল চাকমা, জয়া বড়ুয়া, নাজমুল হোসেন নয়ন, এস এম রিয়াদ, সামিনা ইশরাত, সুতপা বর্মণ, পলি লায়লা, শক্তি নোমান, পলাশ চৌধুরী, পাভিত্রা মেহতা, সাদিয়া শারমিন ও মুনতাসিব রহমান।

‘শিকড়’ (Root) এর ধারণা ছিল এবারের মূল প্রতিপাদ্য। কিউরেটরের তত্ত্বাবধানে শিল্পীরা আত্মপরিচয়, সংস্কৃতি, জাতীয়তা, অভিবাসন, জীবনযাপন ইত্যাদিতে ব্যাপৃত শিকড়ের ধারণাকে নিজেদের শিল্পকর্মে মূর্ত করে তোলেন। শিল্প নির্মাণের জন্য শিল্পীরা বাঁশ, মাটির তৈরি বিভিন্ন দ্রব্য, কাপড়, পড়ে থাকা গাছের গুঁড়ি, পাতা, খড় ইত্যাদি পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহার করেন। 

ক্র্যাক আন্তর্জাতিক আর্টক্যাম্পের অন্যতম আয়োজক শিল্পী ও গবেষক শাওন আকন্দ জানালেন, বাংলার বাউল দর্শনের দুটি খুব শক্তির জায়গা রয়েছে— একটি সহজিয়া জীবনপ্রণালি, অন্যটি যূথবদ্ধতা। বাউলদের বিশ্বাস, মানুষে মানুষে মিলনে জীবন এক অখণ্ডতার দিকে ধাবিত হয়। এই অমলিন জীবনপ্রবাহই বাউল তথা বাংলার মূল সুর। এই মূল সুরকে ধারণ করেই গত ১৩ বছর নিজেদের শিল্পচর্চার পথ খুঁজে চলেছে ক্র্যাক।

নিজেদের বিশ্বাস আর সামর্থ্যের ওপর ভিত্তি করে গত এক যুগের প্রচেষ্টায় শিল্পমননের এক বর্ণিল জগৎ তৈরি করেছে ক্র্যাক। এই জগতে আছে সমকাল, স্বদেশ, স্বাদেশিকতা; আছে কাঁটাতার আর রাজনৈতিক বিভক্তির সীমান্ত পেরিয়ে এক বিপুল বিশ্ব প্রেক্ষাপট। সেখানে দাঁড়িয়ে নিজস্ব শিল্পচর্চার পথ খুঁজতে খুঁজতে ১৩ বছরের এক সফল আয়োজন শেষ করল ক্র্যাক আন্তর্জাতিক আর্টক্যাম্প। 

আর্টক্যাম্পে শিল্পীরা উপস্থিত দর্শকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। 

জাপানের শিল্পী রেইকো সিমুজি এবং বাংলাদেশের শিল্পী পলি লায়লার যৌথ পরিবেশনার মূল উপজীব্য ছিল পতাকা এবং জাতীয়তার নিগড়ে বাধা মানুষের পরিচয়ের যে সংকট, সেই সংকটের বাইরে মানুষের শিকড়ের সন্ধান। বাংলাদেশ ও জাপানের পতাকার লাল বৃত্ত এবং সাদা ও সবুজ রং সেখানে মুছে গিয়ে এক উন্মুক্ত বিশ্বের কথা বলেছে। 

আনান তাঁর পরিবেশনায় সংগীতের মাধ্যমে মানুষের অসীমতার কথা বলতে চেয়েছেন। বলতে চেয়েছেন মানুষের কোনো বিভেদ নেই। মানুষ একই শক্তি থেকে উৎসারিত। সুতপা বর্মণের কাজের শিরোনাম মূলাধার। আকাশগঙ্গার রূপকে তিনি দর্শকদের জানাতে চেয়েছেন এই অসীম ব্রহ্মাণ্ডে সৃষ্টির উৎস খুঁজতে যাওয়াটাই একধরনের অর্থহীন কাজ।

আর্টক্যাম্পের প্রচলিত যে ধারণা, তাকে অতিক্রম করে গেছে ক্র্যাক আয়োজিত এই আন্তর্জাতিক আর্টক্যাম্প। মাল্টিডিসিপ্লিনারি আর্টক্যাম্প হিসেবে ক্র্যাক ধীরে ধীরে তাদের অবস্থান শক্ত করে নিয়েছে বাংলাদেশের শিল্পচর্চার ইতিহাসে।