বাবার সঙ্গে চা বিক্রি করা বিশাল পেল জিপিএ-৫

বাবার সঙ্গে রাত পর্যন্ত দোকানে কাজ করেই প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে বিশাল। ছবি: প্রথম আলো
বাবার সঙ্গে রাত পর্যন্ত দোকানে কাজ করেই প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে বিশাল। ছবি: প্রথম আলো

লিয়াকত আলী (৪৬) ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশনের দুই নম্বর প্ল্যাটফর্মে চা বিক্রি করেন। ছোট ছেলে বিশাল মিয়া (১১) প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত তাঁর কাজে সহযোগিতা করে। এরপর বাড়ি ফিরতে পড়তে বসে। এভাবে পড়াশোনা করেই প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে বিশাল।

জেলা শহরের সাহেরা গফুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে এবারের সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেয় বিশাল। তার দাদাবাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার আড়াইসিধা ইউনিয়নের আড়াইসিধা গ্রামে। সাত বছর আগে লিয়াকত আলী পরিবার নিয়ে জেলা শহরে চলে আসেন। 


মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশনের দুই নম্বর প্ল্যাটফর্মের পূর্ব দিকের বাজারসংলগ্ন স্কুলের পাশের দোকানে গিয়ে দেখা গেল লিয়াকত আলী চা বিক্রির কাজে ব্যস্ত। কিছুক্ষণ পরই মাথায় ও হাতে করে মালামাল নিয়ে দোকানে হাজির বিশাল। মালামাল নামিয়েই ক্রেতাদের থেকে চায়ের দাম সংগ্রহ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে।

বিশালের বাবা লিয়াকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে বিশাল সবার ছোট। বড় ছেলে ইভান মিয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। মেয়ে তারিন আক্তার সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। সাত বছর ধরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশনের দুই নম্বর প্ল্যাটফর্মে চা বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন। বিশাল প্রায় চার বছর ধরে এই কাজে সহযোগিতা করছে। মালামাল আনা, চা বানানো, ক্রেতাদের কাছ থেকে টাকা রাখাসহ সব কাজই করে বিশাল।

বাবাকে সহায়তা করতে প্রতিদিনই সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত দোকানে কাজ করে বিশাল। ছবি: প্রথম আলো
বাবাকে সহায়তা করতে প্রতিদিনই সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত দোকানে কাজ করে বিশাল। ছবি: প্রথম আলো

লিয়াকত বলেন, ‘একা দোকান সামলাতে পারি না। তাই বিশাল এসে সাহায্য করে। প্রতিদিন চা বিক্রি করে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা রোজগার হয়। এই টাকা দিয়েই কোনো রকমে সংসার চলে। ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে উচ্চশিক্ষিত হোক, আমি এটাই চাই। সাহায্য পেলে সন্তানদের পড়াশোনার খরচ চালাতে অনেক সুবিধা হতো।’

সমাপনী পরীক্ষায় কীভাবে এত ভালো ফল? বিশাল বলে, ‘সকালে উঠে স্কুলে যেতাম। চারটার দিকে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতাম। গোসল করে খাবার খেয়ে এলাকার এক বড় আপার কাছে প্রাইভেট পড়তাম। পড়া শেষ করেই বাবার দোকানে চলে আসতাম। কাজ শেষে বাড়ি ফিরে রাত ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। আর পরীক্ষার সময় সারা দিন পড়াশোনা করেছি, সন্ধ্যায় স্টেশনে বাবার কাজে সহযোগিতা করেছি।’ বিশাল আরও বলে, ‘এক স্যার বলেছে ষষ্ঠ শ্রেণির সব বই আমাকে ফ্রিতে দেবেন। আমি পড়াশোনা করব।’

এরই মধ্যে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির জন্য শহরে নিয়াজ মোহাম্মদ উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে বিশাল। এলাকার এক শিক্ষক ষষ্ঠ শ্রেণির সব বই তাঁকে কিনে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, এমনটাও জানাল সে।

সাহেরা গফুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম মহিউদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, বিশালসহ এই বিদ্যালয় থেকে ৩৬ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে। ছেলেটি খুবই মেধাবী ও পরিশ্রমী। পরিশ্রম করে বাবার সঙ্গে কাজ করে এত দূর এসেছে। দারিদ্র্য তাকে আটকে রাখতে পারেনি। ও জীবনে অনেক ভালো করবে।