বর্ষবরণ নানা দেশে, নানাভাবে

সবখানেই এখন খ্রিষ্টীয় নববর্ষ পালনের তোড়জোড় লক্ষ করা যায়। ঢাকা, ১ জানুয়ারি ২০২০। ছবি: দীপু মালাকার
সবখানেই এখন খ্রিষ্টীয় নববর্ষ পালনের তোড়জোড় লক্ষ করা যায়। ঢাকা, ১ জানুয়ারি ২০২০। ছবি: দীপু মালাকার

আজ সকালে যে সূর্যটা উঠেছে আকাশে, সেটি নতুন বছরের প্রথম সূর্য। শুভ খ্রিষ্টীয় নববর্ষ। স্বাগত ২০২০ সাল। পয়লা বৈশাখই আমাদের দেশে সর্বজনীন বড় উৎসব। তবে খ্রিষ্টীয় নববর্ষ, যা ২০০ বছরের ইংরেজ শাসনের কারণে ইংরেজি নববর্ষ হিসেবে পরিচিত হয়েছে এ দেশে, তা-ও উদ্‌যাপিত হচ্ছে প্রতিবছর। সবখানেই এখন দিনটি উদ্‌যাপনের তোড়জোড় লক্ষ করা যায়। বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের কেজো তারিখগুলো আসলে এই নববর্ষের সঙ্গেই যুক্ত, দেশের অভ্যন্তরীণ কাজও হয় এই ক্যালেন্ডারের ভিত্তিতে। তাই চাইলেই এই নববর্ষকে অগ্রাহ্য করা যায় না।

তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে দেশ-বিদেশের নানা ভালো-মন্দ খবর এখন সবার হাতের মুঠোয়। ফলে বিভিন্ন দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়েও আগ্রহ যেমন বাড়ছে, তেমনি তা একটা ছাপও রেখে যাচ্ছে জীবনযাপনে। বন্ধু, প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বামী-স্ত্রী, পরিবার ছাপিয়ে তা স্থান করে নিচ্ছে অফিসে, অফিস শেষে আনন্দঘন পার্টির মধ্যে। তাতে বেড়ে উঠছে নববর্ষ-সংশ্লিষ্ট অর্থনীতি। ফেসবুক-মেসেঞ্জার-টুইটার-হোয়াটসআপ-ভাইবারে নববর্ষের অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি নানা ধরনের কেনাকাটাও চলছে। একসময় ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ লেখা কার্ড আর ফুলের তোড়ার কদর বেড়েছিল। সে ঐতিহ্য চলেছিল অনেক দিন। এখন মনকাড়া নানা উপহারের মধ্যে গ্যাজেট, পোশাক আর খাবারদাবারের কদর বেড়েছে। নববর্ষ এলে একক দোকান থেকে শুরু করে সুপারমার্কেট পর্যন্ত দোকানিদের মনে জ্বলে ওঠে আশার আলো। বিক্রিবাট্টা বেড়ে যায়। কেউ আবার দিনটিকে আনন্দঘন করে তোলে ভ্রমণে গিয়ে।

পৃথিবীর সব দেশে নববর্ষ একই দিনে হয় না। এশিয়ার অনেক দেশেই নববর্ষ আসে এপ্রিলের দিকে। তবে খ্রিষ্টীয় নববর্ষ উদ্‌যাপন করার ক্ষেত্রে দ্বিধা নেই কোথাও।

খ্রিষ্টীয় বছর শুরু হয় রাত ১২টার পর। আনন্দ-উল্লাসের সঙ্গে বছরটা বরণ করে নেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে বহু দেশেই।

ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে একই সময় নববর্ষ উদ্‌যাপন করা হয় না। কোথাও তা বসন্তে আসে, কোথাও আসে শরৎকালে। কোথাও শুরু হয় মার্চে, কোথাও এপ্রিলের মধ্যভাগে। তবে বিদেশি পর্যটকেরা ভারতে আসে বলে খ্রিষ্টীয় নববর্ষ উদ্‌যাপনের চল রয়েছে। মূলত হোটেল-রেস্তোরাঁয়ই জড়ো হয় মানুষ। আর হ্যাঁ, বাংলাদেশের মতোই উপহার কেনার রেওয়াজ তৈরি হয়ে গেছে ভারতেও।

নেপালেরও রয়েছে নিজের নববর্ষ। বসন্তকালেই তারা নববর্ষের যে উৎসব করে, তা বিসকেট নামে পরিচিত। সাধারণত ১০ থেকে ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত চলে এই উৎসব। সারা দেশ আনন্দে মেতে ওঠে। পয়লা জানুয়ারির আগের রাতটিতে নববর্ষের রাত হিসেবে ধরে নেপালেও উদ্‌যাপিত হচ্ছে নববর্ষ। তবে তা এখনো ডালপালা মেলেনি।

ভুটানকে ভূস্বর্গ বললে কেউ অবাক হয় না এখন। সে দেশের প্রকৃতিই জানিয়ে দেয়, এ এক অন্য জগৎ। যদিও ভুটান পর্যটকদের ব্যাপারে কিছুটা উদাসীন। কিন্তু সে দেশে নববর্ষ উদ্‌যাপন করার আলাদা আনন্দ আছে। ভুটানের নববর্ষ ইংরেজি নববর্ষের কাছাকাছি সময়েই হয়।

সোভিয়েত রাশিয়ায় ১০ বছর কাটানোর সময় দেখেছি, ৩১ ডিসেম্বর রাত ১১টা ৫৫ মিনিটের দিকে পার্টির সাধারণ সম্পাদক (পরবর্তীকালে দেশের প্রেসিডেন্ট) জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতেন। ঠিক ১২টায় হাতে তুলে নিতেন শ্যাম্পেনের গ্লাস এবং দেশবাসীকে জানাতেন নববর্ষের শুভেচ্ছা। এমন ভাষণের পর ঘরে ঘরে শুরু হয়ে যেত নববর্ষের পার্টি। এই একটি রাত প্রায় সবাই জেগে থাকত। আনন্দের সীমা-পরিসীমা থাকত না।

এবার পানামার কথা বলা যাক। পানামার মতো কানে তালা লাগানো বর্ষবরণ আর কোথাও হয় না। নতুন বছরে তারা নিজেদের বানানো কুশপুত্তলিকা পোড়ায়। এই কুশপুত্তলিকা হলো ব্যর্থতা, ঈর্ষা, কষ্ট ও অন্যায়ের প্রতীক। হাতের কাছে যা পায়, তাই ঢোলের মতো বাজাতে থাকে। সাইরেন বাজছে, বাসের হর্ন থামাচ্ছে না, ঘণ্টা বেজেই চলেছে—এই আওয়াজ সৃষ্টি করার মূল উদ্দেশ্য সব ধরনের অশুভ যেন ভয়ে দেশ ছেড়ে পালায়।

স্পেনবাসী মাঝরাতে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়, সবাই মিলে ঘুরে বেড়ায়। মাঝরাতের আগে ঘড়ি যখন ১২ বার ঢং ঢং করে ওঠে, তখন ১২টা আওয়াজের সঙ্গে ১২টা আঙুর খাওয়ার রেওয়াজ আছে। কিউবায়ও একইভাবে আঙুর খাওয়ার ঐতিহ্য রয়েছে।

ইতালির মানুষ নতুন বছরে সব ধরনের পুরোনো আসবাব থেকে রেহাই পেতে চায়। তারা অনায়াসে তাদের জানালা দিয়ে চেয়ার–টেবিল, ইস্তিরি, চামচ, বাটি, কাপড়চোপড় দেদার ফেলে দিতে থাকে। পথচারীরা সেদিন সতর্ক হয়ে পথ না চললে বিপদে পড়তে পারে।

গ্রিসের মানুষ নববর্ষে অতিথি হয়ে কোথাও গেলে হাতে নিয়ে যায় ছোট ছোট পাথরের টুকরো। বাড়ির মুখে সে পাথর ছুড়ে ফেলে সাফল্য আর টাকাপয়সা আসার মন্ত্র পড়ে। এ দেশের শিশুরা তাদের জুতা খুলে রাখে দরজার কাছে এবং আশা করে, সেন্ট ভাসিলি এসে এই জুতাগুলো ভরে দেবে উপহারে।

কয়েকটি দেশের নববর্ষের উপহার নিয়ে কিছু কথা হোক এবার। সুইডেনে উপহারের কথা ভাবলেই বিষয়টা সামনে আসে, যা এনে দেবে আলো ও উষ্ণতা। তাই সবচেয়ে ভালো উপহার হিসেবে বিবেচিত হয় মোমবাতি। কত রকমের মোম যে সেখানে উপহার দেওয়া হয়, তার হিসাব নেই।

ফরাসি স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্য অবশ্যই উপহার হিসেবে সবার আগে পছন্দ সুগন্ধি। তবে বাড়ির অন্য সদস্য ও শিশুদের জন্য থাকে অন্য ধরনের উপহার। জার্মানরা পড়ুয়া জাতি। তাই নববর্ষের উপহার হিসেবে বইটাই তারা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে। আর ভ্রমণের টিকিটও উপহার হিসেবে দিতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে জার্মানরা।

নতুন বছরে সবাই নতুন করেই জীবনকে নিয়ে ভাবে। নতুন সম্ভাবনার দ্বার যেন খুলে যায়, সে জন্য নতুনভাবে তৈরি হয় মানুষ। আজ যে সূর্যটা পুবাকাশে উঠল, তা জানাল নতুনের আহ্বান। নতুন ভাবনায় বলীয়ান হয়ে গা ঝাড়া দিয়ে যে এগিয়ে যেতে পারবে, তারই হবে জয়। পুরোনো জঞ্জাল হটিয়ে দিয়ে তাই আমাদের দেশেও সবাই প্রস্তুত হচ্ছে বছরটিকে বরণ করে নিতে।

নতুন বছর সবার জীবনকে পূর্ণ করে তুলুক।

সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা।