অপরাধী চিনিয়ে দিচ্ছে প্রযুক্তি

রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেন সড়কে সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসিক এলাকার একটি বাসায় দিনদুপুরে চুরি হয়েছিল গত জুলাই মাসে। কর কমিশনারের এই বাসা থেকে নগদ টাকা, স্বর্ণালংকার ও অস্ত্র নিয়ে যায় চোরেরা। ঘটনার পর এলাকা থেকে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। কিন্তু অসংখ্য লোকের আনাগোনা থেকে মূল ব্যক্তির পরিচয় শনাক্ত করা ছিল প্রায় অসম্ভব।

পরে দুই মাসের তদন্তে পুলিশ চোরকে শনাক্ত করে। উদ্ধার করে খোয়া যাওয়া অস্ত্র ও স্বর্ণালংকার। ক্লুলেস (সূত্রবিহীন) এ ঘটনায় মূল অভিযুক্তকে প্রযুক্তির সহায়তায় শনাক্ত করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের রমনা অঞ্চল। তদন্ত কর্মকর্তা অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার মো. শামসুল আরেফিন প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনাস্থলের মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কের তথ্য বিশ্লেষণ করে তাঁরা চোরকে শনাক্ত করেন। ওই ঘটনার আগে–পরে ওই স্থানের মোবাইল নেটওয়ার্কের তথ্য পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করতে হয়েছিল।

অপরাধী শনাক্তকরণ ও সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহের ক্ষেত্রে পুলিশ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রযুক্তিনির্ভর। পুলিশের তদন্ত একসময় সোর্স (তথ্যদাতা)–নির্ভর হলেও সেই পন্থা থেকে অনেকটাই তারা সরে এসেছে। কোথাও কোনো অপরাধ ঘটামাত্রই এখন শুরু হয় ওই এলাকায় ব্যবহৃত মুঠোফোনের কল ও খুদে বার্তা আদান–প্রদানের তথ্য বিশ্লেষণ। এ ছাড়া ডিএনএ পরীক্ষা, রাসায়নিক পরীক্ষা, ব্যক্তির বায়োমেট্রিক তথ্য, দূরনিয়ন্ত্রিত রোবটের মতো আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সূত্রবিহীন ঘটনার তদন্তে বেরিয়ে আসছে অপরাধীরা।

মালিবাগ-মৌচাক উড়ালসড়কের আশপাশে অনেক সিসি ক্যামেরা থাকলেও তাতে ধরে পড়েনি একটি হত্যার ঘটনা। গত ২৫ আগস্ট রাতে মুঠোফোনে অ্যাপসভিত্তিক রাইড শেয়ার মোটরসাইকেল চালক মো. মিলনকে (৩৫) সেখানে গলা কেটে হত্যা করা হয়। হত্যাকারী তাঁর মুঠোফোন ও মোটরসাইকেল নিয়ে পালিয়ে যান। এ ঘটনার এক সপ্তাহের মধ্যেই হত্যাকারীকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। উদ্ধার করা হয় মোটরসাইকেল ও মুঠোফোন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের মতিঝিল অঞ্চলের অতিরিক্ত উপকমিশনার আতিকুল ইসলাম বলেন, মুঠোফোনটি হত্যাকারী এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করেছিলেন। ফোনের আইএমইআই নম্বর ধরে অপরাধীকে শনাক্ত করা হয়।

ডিএনএ বিশ্লেষণ

বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে আলামত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণে পুলিশ আগের চেয়ে অনেক বেশি সক্ষম। ঘটনাস্থল থেকে শারীরবৃত্তীয় আলামত যেমন রক্ত, বীর্য, লালা বা অন্যান্য উপাদান সংগ্রহের উপকরণ ও কৌশল এখন থানা পর্যায়েও ছড়িয়েছে। ফলে ঘটনা উদ্‌ঘাটনে এখন ফরেনসিক ও বায়োমেট্রিক আলামতের ব্যবহার অনেক বেড়েছে। সিআইডির পরীক্ষাগারের এসব আলামত বিশ্লেষণের সক্ষমতা রয়েছে।

>

পুলিশের অপরাধ তদন্ত
অপরাধী শনাক্তকরণ ও সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহে পুলিশ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রযুক্তিনির্ভর

নানাবাড়ি বেড়াতে এসে রাজশাহীর বারইপাড়ায় ধর্ষণের শিকার হয় পাঁচ বছরের এক শিশু। পাশবিক এ নির্যাতনের পর গলা কেটে হত্যা করা হয় তাকে। সন্দেহভাজন হিসেবে তার এক নিকটাত্মীয়কে আটক করে পুলিশ। কিন্তু শেষমেশ প্রযুক্তির সহায়তায় তদন্তে বেরিয়ে আসে ওই ব্যক্তি নয়, শিশুটির আরেক নিকটাত্মীয় তাকে ধর্ষণের পর হত্যা করেন।

২০১৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর রাতের এ ঘটনার তদন্ত করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। পিবিআই রাজশাহীর দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনাস্থল থেকে শিশুটির রক্ত, লালা এবং কাপড়ে লেগে থাকা বীর্য সংগ্রহ করে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ল্যাবরেটরিতে পাঠান তাঁরা। সঙ্গে দেন আটক নিকটাত্মীয়ের রক্তও। আলামত বিশ্লেষণ করে ঘটনাস্থলে অন্য ব্যক্তির ডিএনএর মিল পান তাঁরা। পরীক্ষকেরা জানান, ওই ডিএনএ সেই নিকটাত্মীয়েরই কোনো এক ঔরসজাত সন্তানের। এরপরই শনাক্ত হয় মূল অভিযুক্ত। গ্রেপ্তারের পর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেন তিনি।

সন্দেহভাজনদের তথ্যভান্ডার

অপরাধী শনাক্তে পুলিশ এখন তিনটি তথ্যভান্ডার কাজে লাগাচ্ছে। প্রায় এক যুগ ধরে কারাগারে যাওয়া সব সন্দেহভাজনেরই আঙুলের ছাপ, ডিএনএ, চোখের আইরিশসহ পাঁচ ধরনের শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য সংগ্রহে রাখা হচ্ছে। থানাগুলোতে যাদের নামে মামলা হচ্ছে তাদের নাম, বিস্তারিত পরিচয় ও ছবি সংগ্রহে রাখছে পুলিশ। এ ছাড়া অপরাধী বা অজ্ঞাতপরিচয় মৃতদেহ শনাক্তে ব্যবহৃত হচ্ছে জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যভান্ডার। ছদ্মপরিচয়ে থাকা কোনো ব্যক্তি গ্রেপ্তারের পরে আঙুলের ছাপ দেওয়ামাত্রই জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যভান্ডার থেকে উঠে আসছে তাঁর পরিচয়। দেশের প্রত্যন্ত এলাকার কোনো থানায়ও তাঁর বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ থাকলে সেটি খুব অল্প সময়েই জানা যাচ্ছে।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার পুলিশ সেন্টারের ডিআইজি শাহ আলম প্রথম আলোকে বলেন, অপরাধীর গতিপথ শনাক্ত করতে প্রযুক্তি সহায়তা করছে। অপরাধের তথ্যপ্রমাণ উদ্ধারেও এটি অত্যন্ত কার্যকর। আজ থেকে ২০ বছর আগে তদন্ত শুধু সোর্সভিত্তিক ছিল। মনে হতো সোর্স কোনো ভিনগ্রহের মানুষ। পুলিশের চেয়েও শক্তিশালী। প্রায় ৯০ শতাংশ মামলা শনাক্ত হতো সোর্সের দেওয়া তথ্যের সূত্র ধরে। এখন ১০ শতাংশও সোর্সের ওপর নির্ভর করতে হয় না। আর এটা সম্ভব হয়েছে প্রযুক্তির কারণে।

জঙ্গি কার্যক্রম শনাক্তে প্রযুক্তি

বোমা উদ্ধার ও অপসারণেও যুক্ত হয়েছে প্রযুক্তি। এখন ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ যন্ত্রপাতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুটি অত্যাধুনিক রোবট। দূরনিয়ন্ত্রিত রোবটগুলো বোমা খোঁজা, নিষ্ক্রিয় করা থেকে শুরু করে দেয়াল ভাঙা, সিঁড়ি বেয়ে ওঠার মতো কাজও করতে পারে। স্পর্শকাতর কোনো স্থানের নজরদারিতে পুলিশ ড্রোনও ব্যবহার করছে।

জনগণের সঙ্গে পুলিশের সরাসরি সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে জরুরি হেল্পলাইন ৯৯৯ বা বিশেষ কিছু অ্যাপের মাধ্যমে। ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম (সিটি) ইউনিটের অ্যাপ ‘হ্যালো সিটি’ এবং র‍্যাবের ‘রিপোর্ট টু র‍্যাব’–এর মাধ্যমে অপরাধের অনেক তথ্য পাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের উপকমিশনার সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তদন্তে নিত্যনতুন বৈজ্ঞানিক পন্থা তাঁরা অবলম্বন করছেন। প্রযুক্তির ব্যবহারে অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকলে যন্ত্রের ফরেনসিক বিশ্লেষণের সুযোগ থাকে। এখান থেকে অপরাধ প্রমাণের তথ্য যেমন পাওয়া যায়, তেমনি অপরাধ–সংশ্লিষ্ট অনেক তথ্যও বেরিয়ে আসে।

সাইফুল ইসলাম বলেন, জঙ্গিদের গতিবিধি শনাক্তের ক্ষেত্রে তথ্য সংগ্রহের জন্যও প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়। প্রযুক্তি ব্যবহার করে ২০১৭ সালের ১৫ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানে জঙ্গিদের হামলার পরিকল্পনা এবং ধামরাই রথযাত্রা ও সিলেট ক্যান্টনমেন্টের রোডমার্চে হামলার পরিকল্পনার মতো অনেক ঘটনার তথ্যই তাঁরা আগে জানতে পেরেছিলেন। এ কারণে সেগুলো ব্যর্থ করা সম্ভব হয়েছে।

প্রযুক্তির ব্যবহার আদালতে মামলা প্রমাণের ক্ষেত্রেও সহায়ক হচ্ছে বলে মনে করেন পিবিআইর প্রধান বনজ কুমার মজুমদার। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ঘটনা প্রমাণে আগে সাক্ষীর মৌখিক সাক্ষ্যই ছিল অন্যতম প্রধান বিষয়। এখন সেই সাক্ষ্যকে আরও শক্তিশালী করা যায় প্রযুক্তির সাহায্যে ঘটনার সময়, তার অবস্থান এবং কার্যক্রম ব্যাখ্যা করে। তবে প্রযুক্তির ব্যবহার এবং অপরাধ সংঘটনের পর সেই স্থান থেকে আলামত সংগ্রহের বিষয়ে মাঠপর্যায়ের তদন্তকারী কর্মকর্তারা এখনো পুরোপুরি দক্ষ নন। তাঁদের সক্ষমতা বাড়াতে আরও জোর দেওয়া প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।