'বাবা বাড়ি যায় না' তাই পথে নামল ইয়াসিনরা

মজুরি কমিশন বাস্তবায়নসহ ১১ দফা দাবিতে পঞ্চম দিনেও চলছে পাটকলশ্রমিকদের আমরণ অনশন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে সন্তানেরা। প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিলসের সামনে, খুলনা, ২ জানুয়ারি। ছবি: সাদ্দাম হোসেন
মজুরি কমিশন বাস্তবায়নসহ ১১ দফা দাবিতে পঞ্চম দিনেও চলছে পাটকলশ্রমিকদের আমরণ অনশন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে সন্তানেরা। প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিলসের সামনে, খুলনা, ২ জানুয়ারি। ছবি: সাদ্দাম হোসেন

‘লেখাপড়ার নিশ্চয়তা চাই, মানুষের মতো মানুষ হতে চাই’—এমন লেখা কাগজ নিয়ে প্লাটিনাম জুট মিলের প্যান্ডেলের মধ্যে বসে ছিল ছয় বছরের শিশু ইয়াসিন হাওলাদার। পরনের সাদা স্কুল ড্রেস মলিন হয়ে গেছে। ওর দৃষ্টি সামনে চলাফেরা করা মানুষের দিকে। নীরব হয়ে বসে থাকা ইয়াসিন এ বছর স্কুলে ভর্তি হয়েছে।

পাশে গিয়ে আস্তে করে ‘এখানে কেন বসেছ’ জানতে চাইলে আধো আধো কথায় বলে ওঠে ‘বাবা বাড়ি যায় না তাই’। বাবার নাম কী জানতে চাইলে অস্পষ্ট ভাষায় সে বলে ওঠে, ‘মো. রফিকুল ইসলাম’।

খুলনার স্টার জুট মিলে শ্রমিক হিসেবে কর্মরত রফিকুল ইসলাম আমরণ অনশন করছেন ১১ দফা দাবিতে। অবস্থান নিয়েছেন অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে প্লাটিনাম জুট মিলের ফটকের সামনে। সেখানেই পাঁচ দিন ধরে আছেন তাঁরা।

আজ বৃহস্পতিবার ইয়াসিনের মতো এমন শত শত শ্রমিকের সন্তানেরা যোগ দিয়েছিল বাবাদের ওই আন্দোলনে। সকাল ১০টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত বাবাদের জন্য আন্দোলনের স্থলে বসে ওই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে তারা।

সকাল সাড়ে ১০টার দিকে শ্রমিকদের সন্তানেরা এক হয়ে মিছিল নিয়ে খালিশপুরের বিআইডিসি সড়ক ধরে চলে যায় দৌলতপুরে। সরকারি বিএল কলেজের সামনে দিয়ে মিছিল নিয়ে নতুন রাস্তা মোড়ে অবস্থান নেয় তারা। এ সময় ‘বাবা কেন অনশনে পাটমন্ত্রী জবাব দাও’, শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি মেনে নাও নিতে হবে’ এমন নানা স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। ২০ মিনিটের মতো সেখানে অবস্থান নেওয়ায় ওই সড়কে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে সেখান থেকে আবার মিছিল নিয়ে বাবাদের অনশন স্থলে গিয়ে সেখানে বসে পড়ে তারা।

আজ বৃহস্পতিবার টানা পঞ্চম দিনের মতো আমরণ অনশন করছেন খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের শ্রমিকেরা।

গতকাল বিকেল পর্যন্ত অনশনে থাকা ৩০ জনের মতো শ্রমিককে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। সেখান থেকে অনেকেই চিকিৎসা নিয়ে আবার অনশনস্থলে ফিরে এসেছেন। এ ছাড়া অনশনস্থলে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে ১০০ জনেরও বেশি শ্রমিককে। আর শীতের কারণে অসুস্থ বোধ করছেন দেড় হাজারের মতো।

এমন পরিস্থিতিতে আজ সকালে ঢাকায় পাটমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করতে খুলনা ছেড়েছেন শ্রমিকনেতারা। বিকেল পাঁচটায় মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে যোগ দিতে খুলনা থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ও খুলনার আলীম জুট মিলের সিবিএ সাধারণ সম্পাদক সরদার আবদুল হামিদের নেতৃত্বে ২১ সদস্যের একটি দল সেখানে যায়।

এদিকে গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে অনশনস্থলে যান ভাসানী অনুসারী পরিষদের চেয়ারম্যান ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা মো. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। এ সময় তিনি শ্রমিকদের দাবি মেনে নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘কেউ লুটপাট করবে, আর কেউ না খেয়ে বসে থাকবে, তা হতে পারে না। অবশ্য এ জন্য দায়ী আমাদের মতো যাঁরা ঢাকায় বসবাস করেন তাঁরা। এটা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য দুঃখজনক।’

এ সময় জাফরুল্লাহ চৌধুরী কোনো শ্রমিকের সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার উপযোগী হলে তাঁর গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনা খরচায় পড়ানোর ঘোষণা দেন। পাশাপাশি অসুস্থ শ্রমিকদের তাঁর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে বিনা খরচায় চিকিৎসা করানোর আশ্বাস দেন। পরে তিনি অনশনে থাকা শ্রমিকদের মধ্যে কম্বল বিতরণ করেন।

সংহতি জানিয়ে বিএনপির মানববন্ধন
এদিকে পাটকলশ্রমিকদের অনশনের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে মানববন্ধন করেছে খুলনা মহানগর ও জেলা বিএনপি। আজ নগরের কে ডি ঘোষ রোডে অবস্থিত দলীয় কার্যালয়ের সামনে যৌথভাবে ওই মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।

মানববন্ধনে বিএনপি নেতারা বলেন, ন্যায়সংগত দাবি আদায়ে পাটকলশ্রমিকদের আন্দোলনের সঙ্গে সরকার বারবার মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে প্রতারণা করছে। সারা দেশের শিশুরা যখন বই উৎসবে মেতে ওঠে, সে সময় রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলশ্রমিক পরিবারের শিশুরা অনশনরত বাবার পাশে না খাওয়া পেট নিয়ে বসে থাকে। সরকার তার অবৈধ ক্ষমতা দীর্ঘায়িত ও নিরঙ্কুশ করতে ১৫ লাখ সরকারি কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর পে কমিশন ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবায়ন করেছে। অথচ ২০১৫ সালে ঘোষিত পাটকলশ্রমিকদের মজুরি কমিশন আজ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি। সরকারের দুর্নীতি–অনিয়ম অব্যবস্থাপনায় দেশের অর্থনীতি মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে। সরকারের পতন ছাড়া সাধারণ-মেহনতি-খেটে খাওয়া-শ্রমিক শ্রেণির মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে না বলে মন্তব্য করেন তাঁরা।

কর্মসূচিতে সভাপতিত্ব করেন বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও মহানগর সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু। বক্তব্য রাখেন জেলা সভাপতি এস এম শফিকুল আলম, সাধারণ সম্পাদক আমীর এজাজ খান, নগরের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, নগর বিএনপি নেতা মীর কায়সেদ আলী, শেখ মোশারফ হোসেন, জাফরউল্লাহ খান, ফজলে হালিম, অধ্যক্ষ তারিকুল ইসলাম, জেলার নেতা শেখ আবদুর রশিদ, মেজবাউল আলম, সাইফুর রহমান প্রমুখ।