প্রতিবন্ধী মেয়েটির চার হাত-পা চার শিকলে তালাবদ্ধ

শিকলবন্দী তাসলিমা। কাজে যাওয়ার আগে মা চার খুঁটির সঙ্গে তাঁকে এভাবে বেঁধে রেখে যান। ছবি: প্রথম আলো
শিকলবন্দী তাসলিমা। কাজে যাওয়ার আগে মা চার খুঁটির সঙ্গে তাঁকে এভাবে বেঁধে রেখে যান। ছবি: প্রথম আলো

ছোট্ট একটি টিনের চালা। ভেতরে চারপাশের চারটি খুঁটিতে শিকল লাগানো। চারটি শিকলের শেষ অংশে চারটি তালা ঝোলানো। দুই হাত ও দুই পায়ের সঙ্গে লাগানো শিকলই তাসলিমার সারা দিনের সঙ্গী। শিকলে তাসলিমার হাত–পায়ে দাগ পড়েছে। ঝড়বৃষ্টি যা-ই হোক, সারা দিন কাজ করে বাড়িতে মা না ফেরা পর্যন্ত তাসলিমাকে শিকলবন্দী হয়ে ঘরের মেঝেতেই শুয়ে থাকতে হয়।

চিৎকার করলেও কেউ দেখতে আসে না। এটা যেন চারপাশের সবারই গা সওয়া ব্যাপার। পড়ন্ত বিকেলে মা বাড়ি ফিরে শিকলের তালা খুলে ১৮ বছর বয়সী মানসিক প্রতিবন্ধী মেয়েকে গোসল করান। পরে রান্নাবান্না করে মেয়েকে নিয়ে কোনো রকমে খেয়ে শুয়ে পড়েন।

এভাবেই দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে চলছে তাসলিমার এই শিকলবন্দী জীবন। শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার পেরিয়ে মরিচপুরান ইউনিয়নের কয়রাকুড়ি গ্রাম। সেখানেই বাঁশঝাড়ের নিচে ১২ হাত দৈর্ঘ্যের ছোট্ট একটি ভাঙাচোরা ঘরে থাকেন এই মা-মেয়ে।

কয়েকজন প্রতিবেশীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন মনোয়ারার স্বামী আবুল কাশেম। তাঁদের ঘরে তিন ছেলে ও এক মেয়ের জন্ম হয়। তাসলিমার দুই বছর বয়সেই মারা যান আবুল কাশেম। তখন থেকে মনোয়ারা চার সন্তান নিয়ে সংসারের দায়িত্ব নেন। তিনি বাজার থেকে তেল কিনে গ্রামের বাড়ি বাড়ি বিক্রি করে সংসার চালাতেন। তিন ছেলে স্বাভাবিকভাবে বড় হয়ে উঠলেও একমাত্র মেয়েকে নিয়ে পড়েন বিপাকে।

মেয়েটি মানসিক প্রতিবন্ধী। নিজেই নিজের হাত–পায়ে কামড়ান। শরীর থেকে জামাকাপড় খুলে ফেলে দেন। সুযোগ পেলেই দৌড়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। কয়েকবার পানিতেও পড়ে গিয়েছিলেন। তাই ঘরের ভেতর শিকলবন্দী থাকতে হয় তাসলিমাকে। অর্থাভাবে মনোয়ারা মেয়েকে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে পারেননি। স্থানীয় বিভিন্ন কবিরাজি চিকিৎসা করিয়েছেন কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি।

মনোয়ারা বেগমের ছেলেরা বিয়ে করে আলাদা থাকছেন। তাঁরা রিকশা চালিয়ে, কৃষিশ্রমিকের কাজ করে সংসার চালান। মনোয়ারার নিজের নামে ৪ শতাংশ বসতভিটা রয়েছে। ছেলেদের সহযোগিতায় সেখানে কয়েকটি টিন দিয়ে একচালা ঘর তুলেছেন। তবে বড় ছেলে রিকশা চালাতে পরিবার নিয়ে রাজধানীতে চলে যাওয়ায় তাঁর ফাঁকা ঘরে এখন মা-মেয়ে থাকছেন।

মনোয়ারার ভাষ্য, প্রতিদিন সকালে প্রস্রাব–পায়খানা পরিষ্কার করে মেয়ের দুই হাত–দুই পায়ে শিকল পরান। এরপর রান্না করে মেয়েকে খাওয়ানোর পর নিজে খেয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী ফেরি করতে বেরিয়ে পড়েন। সারা দিন মেয়েটি না খেয়ে শুয়ে থাকেন। সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরে মেয়েকে পরিষ্কার করে গোসল করান। এরপর নিজেও গোসল করেন। রান্নাবান্না করে মা-মেয়ে খেয়ে শুয়ে পড়েন। তিনি বাড়িতে থাকলে মেয়েকে শিকল দিয়ে বাঁধেন না। তবে বেশি পাগলামি করলে শিকল লাগানো ছাড়া উপায় থাকে না। ছয়–সাত বছর বয়স থেকেই তাঁকে এভাবে বেঁধে রাখতে হয়।

গতকাল বিকেলে বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, বাঁশঝাড়ের নিচে ১২ হাত দৈর্ঘ্যের ছোট্ট একটি ভাঙাচোরা ঘর। সেই ঘরের মেঝেতে উপুড় করে তাসলিমাকে শুইয়ে রেখে হাত–পায়ে চারদিকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। এ সময় তাসলিমা শব্দে করে চিৎকার করছিলেন। সাংবাদিকদের উপস্থিতি জানতে পেরে মনোয়ারা বাড়ি আসেন। তিনি মেয়েকে দেখাতে শিকলের তালা খুলে দেন। এ সময় তাসলিমা অদ্ভুত আচরণ করতে থাকেন।

মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘এই মেয়েকে ১৬ বছর ধইরা টানতাছি। এখন মেয়ের সঙ্গে আর পারি না। কিন্তু ছাইড়া রাখতে পারি না। কখন কই যায়, নাকি কোনো পুকুরেই পড়ে। তাই মা হইয়াও নিজেই মেয়ের হাত–পায়ে শিকল বাইন্ধা রাখি। মেয়ের কষ্ট দেইখা কইলজাটা ছিঁইড়া যায়। কী করমু কোনো তো উপায় নাই।’

সম্প্রতি মেয়ের একটা প্রতিবন্ধী কার্ড পেতে ৫ হাজার টাকার দিতে হয়েছে। এ ছাড়া গত বছর বিধবা ভাতার কার্ড পেতে আরও ৪ হাজার টাকা দিতে হয়েছে বলে মনোয়ারা জানান। তবে তিনি কারা টাকা নিয়েছেন, তাঁদের নাম প্রকাশে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন।

মরিচপুরান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খন্দকার শফিক আহমেদ জানান, ‘বিষয়টা আমার জানা নেই। তবে আমি পরিবারটার খোঁজ নেব। তবে কেউ যদি প্রতিবন্ধী ও বিধবা ভাতার কার্ডের ব্যাপারে টাকাপয়সা নিয়ে থাকে তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’