এক ডাকোটা থেকে ১৮ ড্যাশ-বোয়িং, রুট-লাভ দুটোই নিম্নমুখী

যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে আসে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের নতুন বোয়িং ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনারের ‘অচিন পাখি’। ছবিটি যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে বোয়িং কারখানার এভারেট ডেলিভারি সেন্টার থেকে তোলা। ছবি : বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়
যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে আসে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের নতুন বোয়িং ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনারের ‘অচিন পাখি’। ছবিটি যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে বোয়িং কারখানার এভারেট ডেলিভারি সেন্টার থেকে তোলা। ছবি : বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়

এই তো সেদিন, গত ২৪ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল থেকে উড়ে ঢাকায় এল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ‘অচিন পাখি’। এর তিন দিন আগে বিমানবহরে আসে একই মডেলের বোয়িং ৭৮৭-৯ মডেলের নতুন অত্যাধুনিক আরেকটি উড়োজাহাজ ‘সোনার তরী’।

ফেরা যাক ৪৮ বছর আগের এই দিনে। ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি। সদ্য স্বাধীন দেশে রাষ্ট্রপতির এক অধ্যাদেশে জন্ম নেয় ‘এয়ার বাংলা ইন্টারন্যাশনাল’, যা আজকের বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এই বিমান সংস্থার বহরে ছিল না একটিও উড়োজাহাজ। ‘ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দারের’ মতো একটি উড়োজাহাজের অপেক্ষায় ছিল সেদিনের এয়ার বাংলা ইন্টারন্যাশনাল। ‘অচিন পাখি’ ও ‘সোনার তরী’ কেবল নয়, প্রায় অর্ধশতবর্ষী বিমানবহরে এখন উড়োজাহাজ রয়েছে ১৮টি। এর মধ্যে ১২টি আবার ব্র্যান্ড নিউ; মানে নতুন ঝকঝকে তকতকে সব উড়োজাহাজ। চার যুগে বিমানে চড়ে প্রায় পৌনে ছয় কোটি যাত্রী আকাশপথে উড়াল দিয়েছে।

বহরে আধুনিক উড়োজাহাজ এসেছে। কিন্তু বিমানের রুট কমেছে। তা ছাড়া ৪৮ বছরের লাভ–লোকসানের হিসাবে লোকসানের পাল্লাটাই ভারী বিমানের। এ সময়ের মধ্যে ২০ অর্থবছরের লাভ করেছে বিমান আর লোকসান হয়েছে ২৮ অর্থবছরে।

৪ জানুয়ারি জন্ম নেওয়ার পর বিমানের আকাশে উড়াল দিতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরও একটি মাস। ১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে সাতটায় ঢাকার তেজগাঁও পুরান বিমানবন্দর থেকে চট্টগ্রামে রওনা হয় বিমানের ডাকোটা মডেলের প্রথম উড়োজাহাজ। পুরোনো জীর্ণ এই উড়োজাহাজের মালিক ছিলেন যোধপুরের মহারাজা। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি বাংলাদেশ বিমানবাহিনীকে উপহার দেন এটি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই ডাকোটা তেজগাঁও বিমানবন্দরে এয়ারফোর্স বেসে রাখা ছিল।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফেরেন। বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পর তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান মুক্তিযুদ্ধ–ফেরত বাঙালি দুই বৈমানিক ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার বীর প্রতীক ও ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দীন আহমেদ বীর উত্তম (পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের বৈমানিক ছিলেন)। এয়ার বাংলা ইন্টারন্যাশনালের উড়োজাহাজ না থাকার কথা বঙ্গবন্ধুকে জানান তাঁরা। বঙ্গবন্ধু এ কথা শুনে ভারত থেকে দুটি এফ-২৭ উড়োজাহাজ আনার কথা তাঁদের বলেন। তখন আলমগীর সাত্তার ও সাহাবুদ্দীন আহমেদ তেজগাঁও বিমানবন্দরে ডাকোটা উড়োজাহাজের কথা জানান। এটি পাওয়া গেলে অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট চালানো যাবে।

১ জানুয়ারি কথা হয় ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার ও ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দীন আহমেদের সঙ্গে। এই দুজন বলেন, ‘১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ফিরে আসার পর একদিন আমরা দুজন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করি। ডাকোটার কথা বলতেই তিনি জেনারেল ওসমানীকে ফোন করেন। ওসমানী সাহেব তখন এ কে খন্দকারকে ফোন করেন। এর পরপরই বিমানবাহিনী থেকে ডাকোটা উড়োজাহাজটি বিমানকে হস্তান্তর করা হয়।’

>
  • ৪৮ বছরে বিমান লাভ করেছে ২০ বার, আর লোকসান ২৮ বার
  • ১৯৭২ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিমান যাত্রী বহন করেছে পৌনে ছয় কোটি
  • ২৯ থেকে কমে এখন ১৭টি আন্তর্জাতিক গন্তব্যে চলাচল করে বিমান

এর আগেই এয়ার বাংলা ইন্টারন্যাশনাল নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ বিমান করা হয়, এ কথা জানিয়ে ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার বলেন, ‘বাংলাদেশ বিমান নামটি কিন্তু বঙ্গবন্ধু নিজে দিয়েছেন। বিমানের লোগো করার দায়িত্ব বঙ্গবন্ধুই দিয়েছিলেন কামরুল হাসানকে। তিনি “বলাকা” লোগোর নকশা করেন। বঙ্গবন্ধু এটি পছন্দ করেন। আজকের বিমান তাই বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে গড়া।’

১৯৭২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ডাকোটা পেলেও বিমানের লোগো ‘বলাকা’ যুক্ত ছিল না। শুধু জাতীয় পতাকা যুক্ত করে পরদিন ৪ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে সাতটায় বিমানের ডাকোটা ঢাকা ছেড়ে চট্টগ্রাম রওনা হয়। ওই ফ্লাইটে যাত্রী ছিলেন ২৫ জনের মতো। উদ্বোধনী ফ্লাইটটি পরিচালনা করেন ক্যাপ্টেন আবদুল খালেক, ক্যাপ্টেন আবদুল মুকিত, ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার। কেবিন ক্রু ছিলেন মিনা চৌধুরী ও সুজা খন্দকার (প্রয়াত অভিনেতা)।

১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে সাতটায় বিমানের প্রথম ফ্লাইট ঢাকা ছেড়ে চট্টগ্রাম রওনা হয়। ওই ফ্লাইটে যাত্রী ছিলেন ২৫ জনের মতো। উদ্বোধনী ফ্লাইটটি পরিচালনা করেন ক্যাপ্টেন আবদুল খালেক, ক্যাপ্টেন আবদুল মুকিত, ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার। কেবিন ক্রু ছিলেন মিনা চৌধুরী ও সুজা খন্দকার (প্রয়াত অভিনেতা)। ছবি: সংগৃহীত
১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে সাতটায় বিমানের প্রথম ফ্লাইট ঢাকা ছেড়ে চট্টগ্রাম রওনা হয়। ওই ফ্লাইটে যাত্রী ছিলেন ২৫ জনের মতো। উদ্বোধনী ফ্লাইটটি পরিচালনা করেন ক্যাপ্টেন আবদুল খালেক, ক্যাপ্টেন আবদুল মুকিত, ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার। কেবিন ক্রু ছিলেন মিনা চৌধুরী ও সুজা খন্দকার (প্রয়াত অভিনেতা)। ছবি: সংগৃহীত

দিন সাতেক ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, সিলেটের পুরোনো বিমানবন্দর ও যশোরে ফ্লাইট চালানো হয়। কিন্তু ১০ ফেব্রুয়ারি আসে বিপত্তি। ওই দিন সন্ধ্যায় কয়েকজন ক্যাডেট পাইলটকে নিয়ে প্রশিক্ষণ ফ্লাইটে যায় বিমানের ডাকোটা। কিন্তু উড্ডয়নের পরপরই এটি বিধ্বস্ত হয়। প্রাণ হারান ক্যাপ্টেন আবদুল খালেক, ক্যাপ্টেন এস এন হায়দার, তিনজন ক্যাডেট পাইলট শরফুদ্দীন বীর উত্তম, মোয়াজ্জেম ও মোস্তফা। 

তখন উড়োজাহাজ-শূন্য হয়ে পড়ে বিমান। ১২ ফেব্রুয়ারি ১২ জন বৈমানিক প্রশিক্ষণ নিতে যান ভারতের হায়দরাবাদে। এর কয়েক দিন পর ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে ভারতের কাছ থেকে দুটি এফ-২৭ উড়োজাহাজ পাওয়া যায়। এরপর অস্ট্রেলিয়া সরকার বাংলাদেশকে দুটি এফ-২৭ অনুদান দেয়। ১৯৭৩ সালে আরও দুটি এফ-২৭ বিমানের জন্য কেনা হয়। ওই বছর বোয়িং ৭০৭ ভাড়া করে বিমান ঢাকা-বাহরাইন-লন্ডন রুটে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করে। ১৯৭৪ সালে বিমান ৩ কোটি টাকা লাভ করে। ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার বলেন, পুরোনো, কম রুটে চলেও ১৯৭৪ সালে বিমান ৩ কোটি টাকা লাভ করে। ওই বছর বিমানের জন্য ৫ কোটি টাকায় একটি সেকেন্ড হ্যান্ড ৭০৭ বোয়িং কেনা হয়। আর এভাবেই ডানা মেলতে থাকে বিমান।

লাভ আছে, লোকসানের পাল্লা বেশি ভারী: ডানা মেলার সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘ হতে থাকে বিমানের ইতিহাস। বহরে কখনো ডিসি-১০, কখনো এয়ারবাস যোগ দেয়। একসময় বিশ্বের তিনটি মহাদেশের ২৯টি শহরে আকাশপথে ফ্লাইট পরিচালনা করত। উড়োজাহাজের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও বর্তমানে দুটি মহাদেশের ১৭টি গন্তব্যে চলছে বিমান। এর মধ্যে ইউরোপের একমাত্র গন্তব্য কেবল লন্ডন। যদিও আগামীকাল থেকে ম্যানচেস্টারে ফ্লাইট চালু করছে বিমান।

তবে বিমানের যাত্রী বহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৭২ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিমান ৫ কোটি ৭১ লাখ ৭ হাজার ৫১৫ জন যাত্রী বহন করেছে। এর মধ্যে ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে বিমানের যাত্রী বেড়েছে সাড়ে সাত লাখ। ২০১৮–১৯ অর্থবছরে বিমানের যাত্রী ছিল ২৭ লাখ ৬২ হাজার ১২২ জন।

৪৮ বছর বয়সী বিমান লাভের মুখ দেখেছে ২০ বার। তবে লোকসানের পাল্লা বেশি, ২৮ বার। চার যুগে লাভ–লোকসানের পরিমাণ হিসাবের খাতা থেকে জানাতে পারেনি বিমানের জনসংযোগ শাখা। বিমানসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রের তথ্যমতে, লাভের চেয়ে লোকসানের পাহাড় অনেক অনেক উঁচু।

বিমানের আয়-ব্যয়ের শাখা থেকে জানা যায়, ১৯৭৪ সালে বিমান প্রথম লাভে আসে। এরপর আবার লোকসানে নামে। ১৯৯১-৯২ থেকে ২০০৩-০৪ অর্থবছর পর্যন্ত ১৩ বছর লাভজনক প্রতিষ্ঠান ছিল বিমান। এরপর থেকে টানা লোকসানে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিমানকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি করে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরই লাভ করে বিমান। এরপর ২০০৯-১০ থেকে ২০১৩-১৪ পর্যন্ত টানা পাঁচ বছর লোকসান দেয় বিমান। তারপর তিন অর্থবছর (২০১৪–১৫ থেকে ২০১৬–১৭) লাভ করে। এর পর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এসে আবারও লোকসান দেয় বিমান। কিন্তু ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২১৮ কোটি টাকা লাভের তথ্য দিয়েছে বিমানের পরিচালনা পর্ষদ। সব মিলিয়ে গত ১০ বছরের মধ্যে ৬ বছরে বিমানের মোট লোকসান ১ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা। বাকি চার অর্থবছর মোট লাভ হয় ৭৭৭ কোটি টাকা।

লাভের কথা বললেও বিমানের কাছে জ্বালানি বাবদ বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) পাওনা ২০০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) পাওনা রয়েছে আরও প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। ভাড়ায় উড়োজাহাজ এনে দেশ-বিদেশে ফ্লাইট পরিচালনার প্রবণতার কারণেও মোটা অঙ্কের লোকসান গুনেছে বিমান।

তবে প্রতিষ্ঠার সময়ে বিমানের দেনা হয় বলে জানান বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মহিবুল হক। গত ২৭ ডিসেম্বর এক সাংবাদ ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর হাতে বিমানের যাত্রা শুরু হয়। যে বকেয়ার কথা বলছেন, ওই সময়ের বকেয়াটা রয়ে গেছে। গত এক অর্থবছরে সিভিল এভিয়েশন, বিপিসির সব পাওনা পরিশোধ করেছে। ১০টি বোয়িংয়ের কিস্তি শোধ করে বিমান এই লাভ করেছে। অনেক আগের বকেয়া পরিশোধ করতে বিমানকে ১০-১২ বছর সময় দিতে হবে।

আজকে বিমানের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে বিমানের সাবেক বৈমানিক ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দীন আহমেদ বলেন, বিমান একসময় পূর্বে জাপানের টোকিও আর পশ্চিমে নিউইয়র্কে চলাচল করত। ২৯টি গন্তব্যে চলে বিমান লাভজনকও ছিল। বিমান পরিচালনায় পেশাদারির অভাব রয়েছে। আজকে ‘সোনার তরী’, ‘অচিন পাখি’র মতো লং রেঞ্জের উড়োজাহাজ এসেছে কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শিতায়। এখন উচিত হবে লং রেঞ্জের এয়ারক্রাফট যথাযথ ব্যবহার করা।