মন খুলে বলা, সমাধানও দ্রুত

হ্যালো ওসি কার্যক্রমের আওতায় নগরের পাথরঘাটায় গিয়ে লোকজনের অভিযোগ শোনেন কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন। অনেক সমস্যার সমাধান দেন তাৎক্ষণিকভাবে। সম্প্রতি ব্রিকফিল্ড রোড এলাকায়।  জুয়েল শীল
হ্যালো ওসি কার্যক্রমের আওতায় নগরের পাথরঘাটায় গিয়ে লোকজনের অভিযোগ শোনেন কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন। অনেক সমস্যার সমাধান দেন তাৎক্ষণিকভাবে। সম্প্রতি ব্রিকফিল্ড রোড এলাকায়। জুয়েল শীল

পড়ন্ত বিকেল। চট্টগ্রাম নগরের পাথরঘাটা সিঅ্যান্ডবি এলাকা। রাস্তার পাশে বসে আছেন প্রায় তিন শ নারী-পুরুষ। একেকজন ছোট্ট একটি বুথে গিয়ে সমস্যার কথা বলছেন। আর হাসিমুখে ফিরে আসছেন। বুথে বসে আছেন কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন। মাদক, উত্ত্যক্তকারী, চাঁদাবাজি, পারিবারিক সমস্যাসহ নানা বিষয়ে থানার ওসিকে কাছে পেয়ে মন খুলে বলছেন স্থানীয় ভুক্তভোগীরা। আর ছোটখাটো বিষয়গুলো তৎক্ষণাৎ সমাধান করছেন। বাকিগুলো সম্পর্কে আইনি পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

সম্প্রতি সরেজমিনে এই চিত্র দেখা গেছে। শুধু ওসি মহসীন নন। চট্টগ্রাম নগরের ১৬ থানার ওসিরা মাসে দুবার করে ছুটে যাচ্ছেন মানুষের কাছে। ছোট্ট একটি বুথে বসে ওসিরা বলছেন, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদের কুফল। আর শুনছেন মাদক, উত্ত্যক্তকারীসহ নানা সমস্যার কথা।

গত জুলাই মাস থেকে নগর পুলিশে চালু হওয়া এই সেবার নাম দেওয়া হয়েছে ‘হ্যালো ওসি’। যেসব ঘটনায় সাধারণ লোক ভয়ে থানায় যান না। ওসিকে নিজের আঙিনায় পেয়ে খুশি তাঁরা।

বৃদ্ধা জমিলা খাতুন। ভিক্ষা করে চলেন। থাকেন পাথরঘাটা নুরজাহান কলোনিতে। তার দুই মেয়ের মধ্যে একজন প্রতিবন্ধী। আরেক মেয়ের সন্তানেরা বড় হয়েছে। মেয়ে আর নাতনিদের নিয়ে চিন্তায় থাকেন। রাস্তায় বের হলেই বখাটেরা উত্ত্যক্ত করে। থানায় গিয়ে পুলিশকে বলার সাহস করেননি কখনো। ওসি তাদের এলাকায় আসবেন খবর পেয়ে দুপুর থেকে অপেক্ষায় আছেন তিনি। বিকেলে ওসি আসার পর তাঁকে মন খুলে নিজের সমস্যার কথা তুলে ধরেন। আর তাৎক্ষণিকভাবে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

জায়গা নিয়ে এক প্রতিবেশী মারধরও ভয়ভীতি দেখালেও কখনো থানায় যাননি রিকশাচালক আবদুল গফুর। হ্যালো ওসি বুথে ওসিকে কাছে পেয়ে তিনি নিজের সমস্যার কথা তুলে ধরেন। একইভাবে ওই এলাকার শামসুন নাহার, মফিজুল ইসলাম চৌধুরীসহ ২০ ভুক্তভোগী নিজেদের সমস্যার কথা বলেন ওসিকে।

আট মামলার আসামি আবদুর রহমান, চার মামলার জুনু বেগম ও সাত মামলার আসামি নুর নাহার বেগম। দীর্ঘদিন থেকে ভালো হওয়ার ইচ্ছে থাকলেও ভয়ে থানায় গিয়ে পুলিশকে বলার সাহস পাননি তাঁরা। হ্যালো ওসি বুথে কোতোয়ালি থানার ওসিকে কাছে পেয়ে নিজেদের সুপথে ফেরার কথা বলেন। ওসি তাঁদের আশ্বস্ত করেন সত্যিকার অর্থে তাঁরা ভালো হতে চাইলে পুলিশের পক্ষ থেকে যা যা করণীয় সব করা হবে। একপর্যায়ে তাঁরা প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসা না করার ঘোষণা দেন।

কোতোয়ালি থানার ওসি নগরের বিআরটিসি জামতলা, রেয়াজউদ্দিন বাজার, তুলাতলী গোয়ালপাড়া, সিআরবি রেসকোর্স, বলুয়ারদিঘী, ইয়াকুবনগর লইট্টাঘাটা ও সর্বশেষ পাথরঘাটায় হ্যালো ওসি কার্যক্রম করেন। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, থানা থেকে বেরিয়ে লোকজনের কাছে যাওয়ায় এখন তাঁরা নির্ভয়ে পুলিশের কাছে আসছেন। এলাকার মাদকসহ নানা সমস্যার কথা ফোনে জানাচ্ছেন। কোনো অপরাধ দেখলেই পুলিশকে খবর দিচ্ছেন। লোকজন সচেতন হওয়ায় মাদক, জুয়া, উত্ত্যক্তের ঘটনা কমে আসছে।

>

১৬ থানার ওসিরা মাসে দুবার এলাকায় গিয়ে মানুষের কথা শুনছেন
সমাধানও দিচ্ছেন তাৎক্ষণিকভাবে
গত জুলাই মাসে চালু হয় এই কার্যক্রম

ওসি মহসীনের মতো নগরের ১৬ থানার ওসিরা থানা কার্যালয়ের বাইরে নিজ এলাকায় মানুষের কথা শুনছেন। তাৎক্ষণিকভাবে সমাধানও করছেন। গত ১৭ ডিসেম্বর আকবরশাহ থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী বিজয়নগর এলাকায় হ্যালো ওসি কার্যক্রমে গিয়ে মানুষের কথা শোনেন। অনুষ্ঠানে মাদক, ডেঙ্গু, ইভটিজিং, কিশোর গ্যাং, জঙ্গিবাদসহ বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতামূলক বক্তব্য দেন। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগের ভিত্তিতে ওই দিনই চারটি মামলা নেয় পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হয় বেশির ভাগ আসামিকে।

পাঁচলাইশ থানার ওসি আবুল কাশেম ভূঁইয়া ২৪ ডিসেম্বর হামজারবাগ রংপুর কলোনিতে হ্যালো ওসি কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এতে উপস্থিত লোকজন চলাচলের রাস্তায় ভাসমান দোকানপাট, বস্তি এলাকায় জুয়ার আড্ডা এবং মাদক ব্যবসা কথা তুলে ধরেন। এ ছাড়া কিছু জায়গায় বখাটেদের আড্ডা এবং উত্ত্যক্তের অপরাধ সম্পর্কে জানান। ওসি আবুল কাশেম ভূঁইয়া সমস্যার কথা শোনে বাড়ান পুলিশি টহল। ধরা পড়ে তিন বখাটে।

বাকলিয়া থানার ওসি নেজাম উদ্দিন ৩০ ডিসেম্বর কালামিয়া বাজারে হ্যালো ওসি কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তিনি বলেন, এলাকায় বহিরাগতদের আড্ডা, ইয়াবা সেবন, স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীদের উত্ত্যক্তের সমস্যার কথা তুলে ধরেন স্থানীয় লোকজন।

চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের কাছে জনগণ নয়, পুলিশই জনগণের কাছে যাবে। এতে মানুষের পুলিশি ভীতি দূর হবে। পুলিশ ও জনগণের দূরত্ব কমলে অপরাধীদের সম্পর্কে তথ্য পাবে পুলিশ। এতে কমবে অপরাধ। পুলিশকে সত্যিকার অর্থে জনগণের বন্ধু হিসেবে গড়ে তুলতে হ্যালো ওসি কার্যক্রমের ভূমিকা রয়েছে।

পুলিশের হ্যালো ওসি কার্যক্রমকে ভালো উদ্যোগ উল্লেখ করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী বলেন, সত্যিকার অর্থে মানুষের সেবার জন্য যেন এই কার্যক্রম চালু থাকে।