২০১৯ সালে ৪৭০২ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ৫২২৭ জনের

নিরাপদ সড়ক চাই জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে ২০১৯ সালের সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান তুলে ধরে। মাওলানা আকরম খাঁ মিলনায়তন, জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা, ৪ জানুয়ারি। ছবি: ফোকাস বাংলা
নিরাপদ সড়ক চাই জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে ২০১৯ সালের সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান তুলে ধরে। মাওলানা আকরম খাঁ মিলনায়তন, জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা, ৪ জানুয়ারি। ছবি: ফোকাস বাংলা

গেল বছরে শুধু সড়ক দুর্ঘটনাই ঘটেছে ৪ হাজার ৭০২টি। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৫ হাজার ২২৭ জন। আহত ৬ হাজার ৯৫৩ জন। সবচেয়ে বেশি ৩০৯টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে রাজধানী ঢাকায়। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বাড়ছে।

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) সংগঠনের করা ‘২০১৯ সালের সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যানে’ এসব তথ্য উঠে এসেছে।

আজ শনিবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের মাওলানা আকরম খাঁ মিলনায়তনে নিসচা আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালে রেলপথে ১৬২টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ১৯৮ জন, আহত ৩৪৭ জন। নৌপথে ৩০টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৬৪ জন এবং আহত হয়েছে ১৫৭ জন আর নিখোঁজ ১১০ জন। তবে আকাশপথে গত বছর কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি।

২০১৯ সালে দেশের সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা বিগত দুই বছরের তুলনায় অনেক বেড়েছে উল্লেখ করে নিসচার প্রতিবেদনে বলা হয়। প্রতিবেদনে এসেছে, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনা ১ হাজার ৫৯৯টি বেশি হয়েছে। ২০১৮ সালে ৩ হাজার ১০৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ৩৯ জন নিহত ও ৭ হাজার ৪২৫ জন আহত হয়েছিল। আর ২০১৭ সালে ৩ হাজার ৩৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ৬৪৫ জন নিহত ও ৭ হাজার ৯০৮ জন আহত হয়েছিল।

সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ পড়েন নিসচার চেয়ারম্যান ও চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। তিনি বলেন, অশিক্ষিত ও অদক্ষ চালক, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, অসচেতনতা, অনিয়ন্ত্রিত গতি, রাস্তা নির্মাণে ত্রুটি, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, আইনের যথাযথ প্রয়োগ না করা এসব দুর্ঘটনার মূল কারণ।

নিসচার প্রতিবেদনে এসেছে, ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৯ জন বাসচালক ও সহকারী এবং ৭২ জন ট্রাকচালক ও সহকারী মারা গেছেন। এ ছাড়া ২ হাজার ৬৬১ জন পথচারী মারা গেছেন, যা মোট দুর্ঘটনার ৫০ দশমিক ৪ শতাংশ। পথচারীরা গাড়ি চাপায়, পেছন দিক থেকে ধাক্কাসহ বিভিন্নভাবে দুর্ঘটনায় পড়েছে। ট্রাফিক আইন সম্পর্কে ধারণা না থাকা, রাস্তা চলাচল ও পারাপারে মোবাইল ব্যবহার, জেব্রা ক্রসিং, আন্ডারপাস, পদচারী-সেতু ব্যবহার না করা, যত্রতত্র পারাপারের ফলে পথচারীরা দুর্ঘটনায় পড়ছে।

নিসচার প্রতিবেদনে বলা হয়, গেল বছর বেশির ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে বড় শহর ও মহাসড়কগুলোতে। অবৈধ যানবাহন—ভ্যান, রিকশা, নছিমন, অটোরিকশা এ জন্য দায়ী বলে প্রতীয়মান হয়। আইনকে অমান্য করে ধীরগতির বাহন মহাসড়কে এখনো চলাচল করে, যা দূরপাল্লার বড় গাড়িগুলোর চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। স্থানীয় প্রশাসন ও হাইওয়ে পুলিশকে এই ব্যাপারে তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা নিতে দেখা যায় না।

২০১২ সাল থেকে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন করে আসছে নিসচা। এবারের প্রতিবেদনটি ১১টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ, টিভি চ্যানেল ও অনলাইন গণমাধ্যমের তথ্য, নিসচার ১২০টি শাখা সংগঠনের তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে।

ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনার প্রকৃত সংখ্যা সঠিক ও নিখুঁতভাবে নির্ণয় করা আমাদের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এটা করার দায়িত্ব সরকারের। ইতিপূর্বে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও পুলিশ, সিভিল সার্জন ও জেলা প্রশাসন থেকে নিরাপত্তা কাউন্সিলে নিয়মিত কোনো তথ্য প্রদান না করার কারণে সরকারিভাবে কোনো পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়ে না। প্রতিবারের মতো এবারও আমরা যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি দুর্ঘটনা অনুসন্ধান সেল গঠন করে প্রতিবছরের সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য জাতির কাছে উপস্থাপন করার অনুরোধ জানাচ্ছি।’

মোটরসাইকেলে দুর্ঘটনা বাড়ছে
নিসচার প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালে মোটরসাইকেলে দুর্ঘটনার সংখ্যা ১ হাজার ৯৮টি। নিহত হয়েছেন ৬৪৮ জন মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহী। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ২০১৯ সালের ২০ অক্টোবরের হিসাব অনুযায়ী দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ২৭ লাখ ৮৬ হাজার ৯৫৪টি। আর ড্রাইভিং লাইসেন্সের সংখ্যা ১৩ লাখ ৬০ হাজার ৯০৩টি। এতে প্রতীয়মান হচ্ছে, ১৪ লাখ ২৬ হাজার ২৫১ জন চালক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাকের ডগা দিয়ে অবৈধভাবে মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ বিআরটিএ তাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে যেন তাদের কিছুই করার নেই।

ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, শহরে মোটরসাইকেলের চালকদের হেলমেট পরার সুঅভ্যাস গড়ে ওঠা এবং সচেতনতা বাড়লেও গ্রামে জেলা পর্যায়ে ও গ্রামে হেলমেট না পরার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এ ছাড়া কঠোর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও প্রশাসনের সামনে দিয়ে লাইসেন্সবিহীন মোটরসাইকেল ও অপ্রাপ্তবয়স্করা মোটরসাইকেল চালাচ্ছে।

২০১৯ সালের জেলাভিত্তিক সড়ক দুর্ঘটনার হিসাবে নিসচার প্রতিবেদনে এসেছে, সারা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ঢাকায় (৩০৯টি)। এতে নিহত হয়েছে ৩৩৫ জন ও আহত হয়েছে ৩২৭ জন। সবচেয়ে কম দুর্ঘটনা ঘটেছে খাগড়াছড়িতে (৭টি)। এতে নিহত হয়েছে ২৭ জন ও আহত হয়েছে ১০ জন। দেশে গত বছর সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ময়মনসিংহে (৪৮৮ জন)। আর সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে কম মারা গেছেন ঝালকাঠিতে (৫ জন)।

সংবাদ সম্মেলনে নিসচার পক্ষ থেকে আটটি সুপারিশ দেওয়া হয়। এর মধ্যে অন্যতমগুলো হলো: ট্রাফিক সিগন্যাল মানা, যত্রতত্র পার্কিং না করা, ওভারটেক বিষয়ে আইন প্রয়োগ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা, সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়গুলো স্কুলের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা, মিডিয়ায় সচেতনতা কার্যক্রম বাড়ানো, দক্ষ চালক তৈরিতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, মহাসড়ক ও প্রধান সড়ক চার লেনে উন্নীত করা, সড়কের ত্রুটি দূর করা।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন নিসচার মহাসচিব সৈয়দ এহসান-উল হক, উপদেষ্টা ও বিআরটিএর সাবেক চেয়ারম্যান আইয়ুবুর রহমান, যুগ্ম মহাসচিব লিটন এরশাদ প্রমুখ।