মসলা চাষে ভাগ্যবদল অনন্তপুরের কৃষকদের

একসময় গ্রামের মাঠজুড়ে দেখা যেত ধানখেত। এখন সেই মাঠজুড়ে শুধু চোখে পড়ে মসলাজাতীয় ফসলের খেত। এই ফসলের চাষই ভাগ্য বদলে দিয়েছে বহু মানুষের।

রংপুরের তারাগঞ্জের এই গ্রামের নাম অনন্তপুর। ১২ বছর আগে গ্রামের আফজাল হোসেন প্রথম মসলাজাতীয় ফসলের চাষ শুরু করেন। তাঁর সাফল্য দেখে অন্যরাও একে একে আদা, হলুদ, রসুন ও পেঁয়াজ চাষে ঝুঁকে পড়েন। একপর্যায়ে পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে এই চাষ। দিনে দিনে গ্রামটির পরিচিতি হয়ে ওঠে ‘মসলার গ্রাম’।

উপজেলা শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরে অবস্থান অনন্তপুরের। গ্রামটিতে ঢুকেই চোখে পড়ে মাঠজুড়ে আদা, রসুন, হলুদ ও পেঁয়াজের খেত। গ্রামের বেশির ভাগ বাড়িতেই চকচক করছে টিনের চালা। আধা পাকা বাড়িও আছে বেশ কয়েকটি। তবে কোথাও শণের তৈরি কুঁড়েঘর নেই। প্রতিটি বাড়িতে আছে স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা। রয়েছে বিদ্যুৎ।

উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান বায়েজিদ বোস্তামী বলেন, মসলাজাতীয় ফসল চাষে যে লাভ বেশি তা প্রথম ধরতে পারেন গ্রামের আফজাল হোসেন। তাঁকে দেখে গ্রামের অন্য বাসিন্দারা ১০ বছর আগে মসলার চাষ শুরু করেন। দুই বছর আগে আফজাল মারা গেছেন। তবে গ্রামটিতে মসলার চাষ বেড়েই চলেছে। সারা বছরই মসলার চাষ হয় গ্রামটির মাঠে। মসলার চাষ করে গ্রামটির দুই শতাধিক মানুষ তাঁদের ভাগ্যের বদল করেছেন। বদলে গেছে গ্রামের চিত্রও।

গ্রামের বাসিন্দা মোজাফর হোসেনের আগে সংসার চলত অনেক কষ্টে। কখনো দিনমজুরি, কখনোবা রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করতেন তিনি। আট সদস্যের পরিবার। আশ্বিন-কার্তিক মাস এলে সমস্যা হতো বেশি। পরিবারের সদস্যদের দিন কাটত এক বেলা খেয়ে। ছয় বছর আগে অন্যের ৫০ শতক জমি বর্গা নেন মোজাফর। সেখানে আদা, হলুদ, রসুন আর পেঁয়াজের চাষ করেন। প্রথম বছরেই বদলে যায় তাঁর ভাগ্য। মসলা বিক্রির টাকায় কেনেন ৪৩ শতক জমি। করেছেন টিনের বাড়ি। এবার ২৫ শতকে আদা, ২০ শতকে হলুদ, ৪০ শতকে রসুন ও পেঁয়াজের চাষ করেছেন তিনি।

আদা চাষ করে গত সাত বছরে পাকা বাড়ি তৈরি ও দেড় একর জমি কিনেছেন গ্রামের সাইফুল ইসলাম। প্রতিবারের মতো এবারও তিনি ৬০ শতকে আদার চাষ করেছেন। ইতিমধ্যে ২৫ শতক জমির আদা বিক্রি করে ৬০ হাজার টাকা আয় করেছেন। সাইফুল বলেন, ধানের চেয়ে আদা চাষে লাভ বেশি। এক একর জমিতে আমন ধান চাষ করতে ব্যয় হয় ২০-২২ হাজার টাকা। উৎপাদিত ধান বিক্রিও হয় ২২-২৩ হাজার টাকায়। কিন্তু এক একরে আদা চাষে ব্যয় হয় ৮০-৯০ হাজার টাকা। আর বিক্রি হয় আড়াই থেকে তিন লাখ টাকায়। ফলে একরে লাভ থাকে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার থেকে ২ লাখ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত।

গত মঙ্গলবার তারাগঞ্জ হাটে হলুদ বিক্রি করতে এসেছিলেন মিজানুর রহমান। তিনিও অনন্তপুর গ্রামের বাসিন্দা। তিনি বলেন, ‘ধান আবাদ করি তো লস। আলু আবাদ করিও পোষাওছে না। এই জন্যে মুই এবার ৭ হাজার টাকা খরচ করি ৫৫ শতক জমিতে হলুদ চাষ করছুনু। হলুদ পাছুন ৪৫ মণ। ৪৫০ টাকা করি ৫৭ মণ হলুদ বেচাছুন ২৫ হাজার ৬৫০ টাকা। খরচ বাদ দিয়া লাভ হইছে ১৮ হাজার ৬৫০ টাকা।’

উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আলতাফ হোসেন বলেন, হলুদ চাষে কোনো ঝুঁকি নেই। খেতে কোনো পোকা আক্রমণ করে না। পরিচর্যাও তেমন করা লাগে না। মার্চ মাসে জমি চাষ করে আদার মতোই হলুদ রোপণ করা হয়। ফসল তোলা হয় নভেম্বর-ডিসেম্বরে মাসে।

গ্রামটির প্রবেশমুখে হবিবার রহমানের বাড়ি। এসএসসি পাস করার পর বেকার ঘুরে বেড়িয়েছেন সাত বছর। মধ্যে ছোটখাটো ব্যবসা করে দেখেছেন। সুবিধা করে উঠতে পারেননি। ২০১৪ সাল থেকে তিনি রসুন চাষ শুরু করেন। এখন রসুন বিক্রি করে বছরে আয় করেন দেড় লাখ টাকার মতো।

হবিবার রহমান বলেন, রসুন চাষে ঝামেলা কম। অন্য ফসলের তুলনায় লাভ বেশি। অক্টোবর-নভেম্বর মাসে জমি চাষ করে রসুন রোপণ করা হয়, তোলা হয় ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে। বেলে-দো–আঁশ মাটিতে রসুন ভালো হয়। এক একরে রসুন চাষে ব্যয় হয় ৫০-৬০ হাজার টাকা। বিক্রি হয় ১ লাখ ৫০ থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা।

পেঁয়াজের খেতে পরিচর্যায় ব্যস্ত থাকা ৬০ বছরের বৃদ্ধ মজিবর রহমান বলেন, ‘আগোত মুই খালি ধানের আবাদ করছুনুং। গত বছর পেঁয়াজ আবাদ করি ধানের চেয়া দ্বিগুণ লাভ করছুং। এই জন্যে মুই এ্যালা মোর উঁচা জমিগুলাত খালি পেঁয়াজের আবাদ করোং। এবার ৫০ শতক জমির পেঁয়াজ কয় দিন আগোত বেঁচে খরচ বাদে ৮০ হাজার টাকা লাভ করছুং।’

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা অশোক কুমার বলেন, ধান চাষের চেয়ে মসলাজাতীয় ফসল চাষে লাভ বেশি। তাই অনন্তপুর গ্রামের ধনী-গরিব সবাই আদা, হলুদ, রসুন ও পেঁয়াজের চাষে ঝুঁকছেন। এখানকার মসলা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ঢাকায় যাচ্ছে। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে গ্রামটির কৃষকদের আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ ও রোগবালাই দমানোর পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।