প্রতিবন্ধীদের ভরসা কিশোর

প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে কিশোর চাকমা (হুইল চেয়ার বসা)। সম্প্রতি বেতছড়ি মুখ এলাকায় বাড়ির সামনে।  প্রথম আলো
প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে কিশোর চাকমা (হুইল চেয়ার বসা)। সম্প্রতি বেতছড়ি মুখ এলাকায় বাড়ির সামনে। প্রথম আলো

খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার কমলছড়ি ইউনিয়নের বেতছড়িমুখ এলাকার বাসিন্দা কিশোর চাকমা (৩১)। ছোট থেকে স্বপ্ন দেখতেন পড়াশোনার পাট চুকিয়ে সংসারের হাল ধরবেন। হঠাৎ একটি দুর্ঘটনা তাঁর জীবনের সবকিছু এলোমেলো করে দেয়। সেই থেকে কিশোরের জীবন শুরু হয় হুইলচেয়ারে। নিজের স্বপ্ন ভেঙে গেলেও নতুন করে লড়াই শুরু করতে দেরি করেননি তিনি। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধীদের কষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন। এ জন্য এগিয়ে এসেছেন তাঁদের সহায়তায়। এখন কিশোর চাকমার হাত ধরে স্বাবলম্বী হচ্ছেন প্রতিবন্ধীরা। তিনি এখন প্রতিবন্ধীদের আশার আলো। 

প্রতিবন্ধীদের স্বাবলম্বী করতে কিশোর কাজ করছেন নানাভাবে। বিনা মূল্যে প্রতিবন্ধী, অসহায় ও গরিবদের দিচ্ছেন কম্পিউটার ও সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ। আবার যাদের প্রশিক্ষণ নেওয়ার ক্ষমতা নেই তাদেরও দিচ্ছেন নানা ধরনের পরামর্শ। দুর্গম এলাকার প্রতিবন্ধীদের কথা ভেবে কোনো ধরনের সহযোগিতা ছাড়া ২০১৮ সালে গড়ে তুলেছেন ‘স্বপ্ন প্রতিবন্ধী সংগঠন ও ট্রেনিং সেন্টার’ নামে একটি সংগঠন। সেখানে বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ২০০ বেশি শিক্ষার্থী। বর্তমানে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন আরও ৩১ জন। এ ছাড়া লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার দুর্গম বর্মাছড়ি ইউনিয়নের দুজন প্রতিবন্ধীকে নিজের ঘরে রেখে পড়াশোনা করাচ্ছেন তিনি।

সম্প্রতি খাগড়াছড়ি বাজার থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে বেতছড়িমুখ এলাকার গিয়ে দেখা যায়, ১২ ফুট প্রস্থ ও ২২ ফুট দৈর্ঘ্যের বাঁশের বেড়া আর টিনের জরাজীর্ণ একটি ঘর। বাড়ির অধিকাংশ জায়গাজুড়ে রয়েছে ছয়টা সেলাই মেশিন এবং দুটি কম্পিউটার। সেখানেই চলে কম্পিউটার এবং সেলাই প্রশিক্ষণ। আর বাড়ির বাকি জায়গায় স্ত্রী চঙ্কি চাকমা ও দেড় বছর বয়সী ছেলে আর্যকে নিয়ে থাকেন তিনি। 

 ঘরের আঙিনায় কথা হয় কিশোর চাকমার সঙ্গে। তিনি বলেন, বাবা মিলন কান্তি চাকমা এবং মা কমলা দেবী তালুকদারের পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি চতুর্থ। তাঁর কৃষক বাবার স্বপ্ন ছিল একদিন সরকারি চাকরি করে পরিবারের হাল ধরবেন তিনি। সেই আশায় ২০০৯ সালে গাজীপুর কলেজে অনার্সে ভর্তি হন। হোস্টেল না থাকায় সে কলেজ ছেড়ে ভর্তি হন গাজীপুরের অ্যাডভেন্টিস সেমিনারি অ্যান্ড কলেজে। সে বছর সেপ্টেম্বর মাসে কাপড় শুকাতে গিয়ে হোস্টেলের তিনতলার ছাদ থেকে পড়ে যান তিনি। আঘাত পান মেরুদণ্ডে। দীর্ঘদিন ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ভারতে চিকিৎসা করালেও কোনো উন্নতি হয়নি। এ ছাড়া সাভারের পঙ্গু হাসপাতালে টানা দুই বছর চিকিৎসাধীন ছিলেন। চিকিৎসা নেওয়ার পাশাপাশি সেখানে শিখেছেন কম্পিউটার। পরিবারের কথা চিন্তা করে ২০১২ সালে ফিরে আসেন গ্রামের বাড়িতে। 

বাড়ি আসার পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। ঘর থেকে বের হতেন না। পরে ভাবলেন সমাজের জন্য কিছু করবেন। এরপর এলাকার গরিব, এতিম ও প্রতিবন্ধীদের বিনা মূল্যে পড়ানো শুরু করেন তিনি। এখন পর্যন্ত ৫০ জনকে পড়িয়েছেন। যারা অনেকে এখন অনার্সে পড়ছে। 

তিনি আরও বলেন, ‘গ্রামে এসে উপলব্ধি করলাম সমতলের প্রতিবন্ধীদের চাইতে পাহাড়ের প্রতিবন্ধীরা অনেক অসচেতন। প্রতিবন্ধীদের ভাতা আছে এটা অধিকাংশ প্রতিবন্ধী জানেন না। একটা পর্যায়ে এসে ভাবলাম প্রতিবন্ধীদের জন্য স্থায়ী কিছু একটা করি। সেই চিন্তা থেকে ২০১৮ সালে গড়ে তুলি স্বপ্ন প্রতিবন্ধী সংগঠন ও ট্রেনিং সেন্টার। প্রথম দুটি সেলাই মেশিন ও একটি কম্পিউটার দিয়ে ১৫ জন প্রতিবন্ধীকে নিয়ে যাত্রা শুরু করি। আজ সংগঠনের সদস্য ৯১ জন। এ ছাড়া এই সংগঠনের পাশাপাশি গড়ে তুলেছি ব্লাড ফাউন্ডেশন নামে আরও একটি সংগঠন। এই সংগঠন থেকে এখন পর্যন্ত ৩১ জনকে রক্ত দেওয়া হয়েছে।’

কীভাবে সংসার চলে প্রশ্ন করলে বলেন, এখনো পরিবারের ভার বৃদ্ধ পিতা ও বড় তিন বোনের ওপর। প্রতিবন্ধীদের জন্য পরিবার থেকে খুব একটা সহযোগিতা পান না। এখনো পাননি কোনো ধরনের সরকারি সুযোগ-সুবিধা। এমনকি তিনি নিজেও প্রতিবন্ধী ভাতাও পান না। 

কম্পিউটার টাইপ ও অনলাইনভিত্তিক কিছু কাজ করে আয় হয় তাঁর। ওই আয় দিয়ে চলে সংগঠনের খরচ। এ ছাড়া সচ্ছল পরিবারের কয়েকজন শিক্ষার্থীও পড়িয়ে কিছু টাকা আয় করেন তিনি। 

 সংগঠনটিতে বিনা মূল্যে সেলাই প্রশিক্ষণ দেন উমাচিং মারমা ও প্রজ্ঞা তালুকদার। কথা হয় তাঁদের সঙ্গে। তাঁরা বলেন, ‘কিশোর প্রতিবন্ধী ও অসহায়দের জন্য মহৎ কাজ করছেন। আমাদের বাড়িও একই এলাকায় যেহেতু আমরা সেলাই কাজ জানি তাই ভাবলাম কিশোরের পাশে থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁদের সহযোগিতা করার।’ 

কিশোরের সংগঠন থেকে সেলাই শিখে এখন আয় করছেন শারীরিক প্রতিবন্ধী অনামিকা চাকমা (২১)। তিনি বলেন, ‘২০১৮ সালে আমি সেলাই শিখেছি। এরপর আত্মীয়স্বজনের সহযোগিতায় একটি সেলাই মেশিন কিনেছি। একটা সময় আমাকে পরিবারের কেউ মূল্যায়ন করত না। হাঁটতে পারি না তাই অনেকটা অবহেলা করত। আর এখন প্রতি মাসে আমি এক-তিন হাজার টাকা আয় করি। কিশোর চাকমা আমাকে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছেন।’ 

কিশোর চাকমার স্বপ্ন প্রতিবন্ধীদের জন্য একটি আবাসিক ভবন করবেন। সেখানে থেকে দুর্গম এলাকার প্রতিবন্ধীরা কম্পিউটার ও সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ নেবে, পড়ালেখা করবে।