রোহিঙ্গারা কাঠ পোড়াচ্ছে অনেক কম

গাছ কেটে পাহাড় ন্যাড়া করে ফেলেছে রোহিঙ্গারা। কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালীর একটি রোহিঙ্গা ক্যাম্প। প্রথম আলোর ফাইল ছবি।
গাছ কেটে পাহাড় ন্যাড়া করে ফেলেছে রোহিঙ্গারা। কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালীর একটি রোহিঙ্গা ক্যাম্প। প্রথম আলোর ফাইল ছবি।

রোহিঙ্গাদের মধ্যে জ্বালানি কাঠ ব্যবহারের পরিমাণ গত ছয় মাসে ৮০ শতাংশ কমেছে। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ৯৭ শতাংশ রোহিঙ্গা এখন তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) ব্যবহার করে। শুধু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নয়, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যেও জ্বালানি কাঠ ব্যবহারের পরিমাণ কমে এসেছে। জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) ইন্টার এজেন্সি এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট টেকনিক্যাল ওয়ার্কিং গ্রুপের (ইইটিডব্লিউজি) সঙ্গে মিলে সম্প্রতি একটি সমীক্ষা পরিচালনা করেছে। তাতে এই চিত্র উঠে এসেছে।

ওই সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিনা মূল্য এলপিজি দেওয়ার পরেও রোহিঙ্গারা অল্প পরিমাণে হলেও জ্বালানি কাঠ ব্যবহার করছে। এলপিজি দেওয়ার আগে তারা দিনে প্রায় পৌনে পাঁচ কেজি কাঠ ব্যবহার করত। বর্তমানে তারা দিনে এক কেজি করে কাঠ ব্যবহার করছে। অন্যদিকে স্থানীয় বাংলাদেশি জনগোষ্ঠী দিনে ৫ কেজি ৩৭০ গ্রাম কাঠ ব্যবহার করত। সেটাও কমে আড়াই কেজিতে নেমে এসেছে। অর্থাৎ স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যেও এলপিজি ব্যবহারের পরিমাণ বেড়েছে। এতে সামগ্রিকভাবে কক্সবাজারের বন ও গাছ কাটার পরিমাণ কমেছে।

রোহিঙ্গা টেকনাফ ও উখিয়ায় আশ্রয় নেওয়ার পর ওই এলাকার প্রায় ছয় হাজার হেক্টর বনভূমি উজাড় হয়ে যায়। প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা তাদের রান্নার জ্বালানি কাঠ ও ঘর বানানোর সরঞ্জাম হিসেবে কক্সবাজার এলাকার বনভূমি কাটতে শুরু করে। এক বছরের মধ্যে ছয় হাজার হেক্টর বনভূমি এভাবে উজাড় হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে কক্সবাজারের পরিবেশ নিয়ে দেশে-বিদেশে উদ্বেগ দেখা দেয়। এই অবস্থায় ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে শরণার্থী ও স্থানীয় উভয় জনগোষ্ঠী জন্য বিকল্প জ্বালানি হিসেবে এলপিজি ব্যবহার শুরু হয়।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ওই গবেষণার দলনেতা ও ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ কে এনামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গাদের জ্বালানির চাহিদা মেটানোর জন্য যে কাঠগুলো সংগ্রহ করা হতো, তা শুধু কক্সবাজার এলাকার বন ধ্বংস করে আসত না, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ আশপাশের জেলাগুলো থেকে ওই কাঠ আসত। ফলে এলপিজি দেওয়ার মাধ্যমে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের আরও বেশি বন উজাড় হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেল। এ কারণে রোহিঙ্গাসহ স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে কাঠের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে এলপিজি দেওয়া চালিয়ে যেতে হবে।

তবে গবেষণাটিতে দেখা গেছে, বেশির ভাগ রোহিঙ্গাকে এলপিজি দেওয়ার পরেও শিবিরগুলোয় কাঠের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। গবেষণার সময় দেখা গেছে, ৫১ শতাংশ রোহিঙ্গার বাড়িতে কাঠ ও চারকল (গোবর ও পাটখড়ির তৈরি বিশেষ ধরনের জ্বালানি) রাখার জায়গা রয়েছে। এর মধ্যে ৩৩ শতাংশ ঘরের ওই স্থানে কাঠ ও চারকল মজুত থাকতে দেখা গেছে। রোহিঙ্গাদের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তারা বলেছে, মূলত একটি এলপিজি দেওয়ার পর শেষ হওয়ার পর তারা আরেকটি এলপিজির বোতল পায়। এর মাঝখানের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে অনেক সময় তাদের জ্বালানির ঘাটতি দেখা দেয়। আবার অনেক সময় বিশেষ জরুরি প্রয়োজনের জ্বালানির বেশি দরকার হয়। ওই বিশেষ জরুরি প্রয়োজনের সময় তারা কাঠ পুড়িয়ে রান্না করে থাকে।

শরণার্থী ও স্থানীয় মানুষের জীবন ও পরিবেশের ওপর বিকল্প জ্বালানির প্রভাব যাচাই করার জন্য প্রায় ১ হাজার ২০০ রোহিঙ্গা পরিবার ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিকটবর্তী প্রায় ২০০ স্থানীয় বাংলাদেশি পরিবার মিলে মোট ১ হাজার ৪০০ পরিবার থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এ ছাড়া উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশপাশের ১০টি বাজার থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

গ্লোবাল রিফিউজি কমপ্যাক্টের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদানকারী স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর চাপ কমানো, আর সে জন্যই ইউএনএইচসিআর ও আইওএম রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর কাছাকাছি স্থানীয় বাংলাদেশি পরিবারগুলোর মধ্যে এলপিজি বিতরণ শুরু করে। লক্ষ্য হচ্ছে যৌথভাবে ৫৫ হাজার স্থানীয় পরিবারকে এই সহযোগিতার আওতায় নিয়ে আসা। ইতিমধ্যেই স্থানীয় পরিবারগুলোয় এলপিজির ব্যবহার ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০ শতাংশ হয়েছে। যার ফলে ওই পরিবারগুলোর জ্বালানি কাঠের চাহিদা ৫৩ শতাংশ কমে গেছে।

আইইউসিএনের কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ রাকিবুল আমিন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এলপিজি বিতরণের ফলে জ্বালানি কাঠের বাজারের পুরো চিত্রই বদলে গেছে। সমীক্ষায় আমরা জানতে পেরেছি, নিকটস্থ বাজারের দোকান ও ডিলারদের কাছে সহজলভ্য এলপিজি থাকার কারণে স্থানীয় জনগণ তাদের বাড়ি ও খাবার রেস্তোরাঁগুলোয় এলপিজি ব্যবহার করা শুরু করছে।’ সাশ্রয়ী বিকল্প জ্বালানির এই সহজলভ্যতার মাধ্যমে স্থানীয় জনগণ ও স্থানীয় পরিবেশ দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে উপকৃত হবে।

খাদ্যাভ্যাস ও পুষ্টিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে এলপিজি। ধোঁয়া ও দূষণমুক্ত হওয়ায় রান্নাঘরে রান্না করাও এখন অনেক সহজ। এলপিজি ব্যবহারকারী পরিবারগুলোয় আরও বেশি রান্না হচ্ছে, খাবারে এসেছে বৈচিত্র্য। তাদের শাকসবজি রান্নার হার বেড়েছে, তাই তাদের খাবারে যোগ হচ্ছে অধিক ভিটামিন ও সুষম পুষ্টি।

বাংলাদেশে ইউএনএইচসিআর বাংলাদেশের প্রতিনিধি স্টিভেন করলিস এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, এলপিজির ব্যবহার বাড়ায় জ্বালানি কাঠের চাহিদা ও দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ার ফলে পুনর্বনায়ন সম্ভব হচ্ছে। এতে পরিবেশ সংরক্ষণের মাধ্যমে কক্সবাজারের পরিবেশের সামগ্রিক উন্নয়ন হবে।