দিদিমণির স্কুলে অনেক মজা

খেলায় শিশুদের সঙ্গ দিচ্ছেন মার্গারেট লাকড়া।
খেলায় শিশুদের সঙ্গ দিচ্ছেন মার্গারেট লাকড়া।

কক্ষের ভেতর শিশুদের কলধ্বনি। ঢুকলেন দিদিমণি। এবার একসঙ্গে সবাই বলে উঠল—শুভ সকাল। কুশল বিনিময় শেষে হাত মুঠি করে ধরল শিশুরা। কণ্ঠ মিলাল দিদিমণির কণ্ঠে—সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারা দিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি...।

হাতেখড়ি শিক্ষাকেন্দ্র নামের একটি প্রতিষ্ঠানের দিন শুরু হয় এভাবে। দিনাজপুর জেলা শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে মির্জাপুর খ্রিষ্টানপাড়ায় অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটি। মার্গারেট লাকড়া (৬৫) নামের এক নারী নিজের বাড়িতে চালান এটি। এখানে তিন থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে আনন্দপাঠ দেওয়া হয়।
মার্গারেট লাকড়া বলেন, শিশুরা পাখির মতো। তাই এই শিক্ষাকেন্দ্রে পড়তে আসা শিশুদের তিনি পাখি বলতে আনন্দবোধ করেন। তিনি পাখিদের সঙ্গে সময় কাটাতে পছন্দ করেন। এসব পাখিদের কারও মুখে কথাও ফোটেনি ঠিকমতো। তাদের মুখে ‘অ, আ, ক, খ’ তুলে দেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি।

সোমবার সকালে গিয়ে দেখা যায়, বাঁ দিকে একটি দোলনা। তার পাশে একটি প্লাস্টিকের ঘোড়া। আলপনাসজ্জিত পাকা উঠান পেরিয়ে প্রায় ৩০ ফুট লম্বা টিনের ছাউনি দেওয়া পাকা ঘর। সামনে ঝোলানো কাগজে লেখা—হাতেখড়ি শিক্ষাকেন্দ্র। ভেতরে চলছে শিশুদের শপথ—আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে। আমি যেন সেই কাজ করি ভালো মনে...।

সরেজমিনে দেখা গেল, শপথ নেওয়ার পালা শেষ হওয়ার পর শিশুরা মেঝেয় গোল হয়ে বসল। তাদের সামনে প্লাস্টিকের বালতি এনে উপুড় করলেন দিদিমণি। বেরিয়ে এল হরেক রকমের খেলনা। সেসব নিয়ে মেতে উঠল শিশুরা।

মার্গারেট লাকড়া জানালেন, বর্তমানে এ কেন্দ্রে ৪৫ জন শিশু আছে। তাদের মধ্যে নিয়মিত আসে ৩৫ জনের বেশি। সপ্তাহের পাঁচ দিন তাদের নিয়ে মেতে থাকেন তিনি। সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত পাঠদান করেন তিনি।

কেন্দ্রটির বাইরে অপেক্ষা করছিলেন অভিভাবক ষষ্ঠী মাহাতো। তিনি বলেন, ‘আমার মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলাম। ভয়ে সেখানে যায় না। পরে দিদির এখানে ভর্তি করাই। এখন সবার সঙ্গে মিশে ভয়টা কেটে গেছে। সকালে ঘুম ভাঙলেই স্কুলে আসার জন্য অস্থির করে ফেলে।’

আরেক অভিভাবক দুর্জয় রায় বলেন, তাঁর ছেলেকে ছয় মাস আগে এখানে ভর্তি করিয়েছেন। এই কয়েক মাসেই ছেলে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ পরিচিতিসহ লিখতে পারে। ছয় বছর বয়স হলে ছেলেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়ে ভর্তি করাবেন তিনি। তার আগে এখানে ছেলের হাতেখড়িটা ভালো করে হোক।

শ্রেণিকক্ষে বাচ্চাদের পড়াচ্ছেন মার্গারেট লাকড়া।
শ্রেণিকক্ষে বাচ্চাদের পড়াচ্ছেন মার্গারেট লাকড়া।

ব্যক্তি জীবনে মার্গারেট দুই ছেলে এক মেয়ের মা। স্বামী ভিক্টর লাকড়া (৬৬) বেসরকারি একটি সংস্থার পরিচালক। বড় ছেলে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। ছোট ছেলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্প্রতি প্রকৌশলে ডিগ্রি নিয়েছেন। মেয়েকে পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে দিয়েছেন।

পরিবার সূত্রে জানা যায়, কর্মজীবনে শিক্ষকতা পেশায় আসার ভীষণ ইচ্ছে ছিল মার্গারেটের। সেই বাসনা থেকে ১৯৭৪ সালে এসএসসি পাস করার পরের বছর শিক্ষকতায় যোগ দেন দিনাজপুর শহরের খালপাড়া এলাকায় ইয়াংমেন খ্রিস্টিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের (ওয়াইএমসিএ) পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। জাপান সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত এ প্রতিষ্ঠানে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত চাকরি করেন। পরে ইয়াং উইমেন খ্রিস্টিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের (ওয়াইডব্লিউসিএ) আরেকটি শিক্ষাকেন্দ্রে যোগ দেন তিনি। এ কেন্দ্রটি তাঁর বাড়িতে পরিচালিত হতো। ২০০৬ সালের শেষ দিকে সেটি দিনাজপুর শহরের কবসা এলাকায় স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু স্থানীয় অভিভাবকদের অনুরোধে মার্গারেট নিজের বাড়িতে পরিচালিত শিক্ষাকেন্দ্রটি বন্ধ করতে পারলেন না। ২০০৭ সালে স্বামীর সহযোগিতায় বাড়িতেই শুরু করলেন নতুন শিক্ষাকেন্দ্র। নাম দিয়েছেন—হাতেখড়ি।

মার্গারেট লাকড়া জানালেন, গত ১৩ বছরে প্রায় সাড়ে ৪০০ বাচ্চার হাতেখড়ি দিয়েছেন তিনি। এখান থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো তৈরি বাচ্চা পাচ্ছে। ভর্তির সময় অভিভাবকদের কাছ থেকে নামমাত্র এক শ করে টাকা নেওয়া হয়। মাসিক বেতন ৫০ টাকা। কেউ দেয়, কেউ দেয় না। এই টাকায় তিনি কেন্দ্রের বিদ্যুৎ বিল, বাচ্চাদের খেলনা ও শিক্ষা উপকরণ কেনেন। সরকারিভাবে কোনো অনুদানও পান না তিনি। তবে হাজার ব্যস্ততার মাঝেও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি বাচ্চাদের হাতেখড়ি দিয়ে যেতে চান।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ক খ আলাওল হাদী আজ মঙ্গলবার মুঠোফোনে বলেন, ‘এত চমৎকার শিক্ষাকেন্দ্রটির খবর জানতাম না। যদি পারা যায়, আগামী বছর থেকে কেন্দ্রটিতে বাচ্চাদের বই সরবরাহের ব্যবস্থা করব।’