সারওয়ার আলীকে হত্যাচেষ্টায় কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী। ছবি: সংগৃহীত
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী। ছবি: সংগৃহীত

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলীকে সপরিবার হত্যাচেষ্টার ঘটনায় জড়িত কাউকেই এখন পর্যন্ত শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। কী উদ্দেশ্যে এবং কারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে, সে বিষয়েও কোনো ধারণা করতে পারছেন না পুলিশের কর্মকর্তারা। গুরুত্ব দিয়ে ঘটনাটির তদন্ত চলছে, এর বাইরে কিছু বলতে চাইছেন না তাঁরা।

থানা-পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) এবং পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সদস্যরা ঘটনাটির তদন্ত করছেন। তাঁরা সারওয়ার আলী এবং তাঁর পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ওই বাড়ি থেকে পাওয়া আলামতগুলো বিশ্লেষণ করছেন।

সারওয়ার আলী ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি ও চিকিৎসক। তাঁর স্ত্রী মাখদুমা নার্গিস কমিউনিটি ক্লিনিকের সাবেক প্রকল্প পরিচালক। গত রোববার রাতে উত্তরায় বাড়িতে ঢুকে সারওয়ার আলী, তাঁর স্ত্রী, তাঁদের মেয়ে সায়মা আলী, জামাতা হুমায়ুন কবিরকেও ছুরিকাঘাত করে হত্যার চেষ্টা চালায় দুর্বৃত্তরা। তখন তাঁদের বাঁচাতে এগিয়ে আসা দুই প্রতিবেশীকেও দুর্বৃত্তরা ছুরিকাঘাত করে। ভয়াবহ এই ঘটনায় গত সোমবার রাতে রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় দুজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় চার-পাঁচজনকে আসামি করে মামলা করেন সারওয়ার আলী।

গতকাল দুপুরে সারওয়ার আলীর উত্তরার বাসায় গিয়ে দেখা যায়, পিবিআই সদস্যরা তাঁর সঙ্গে কথা বলছেন। পরে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গেও কথা বলেন পিবিআই কর্মকর্তারা। এর আগে ডিবির কর্মকর্তারাও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন। পরে সারওয়ার আলী প্রথম আলোকে বলেন, এটি ডাকাতির কোনো ঘটনা নয়। হামলার পেছনে জঙ্গিগোষ্ঠী রয়েছে বলে তাঁর ধারণা।

পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার বসির উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, বলার মতো এখনো কোনো তথ্য তাঁরা পাননি। সবকিছু পরিষ্কার হতে আরও সময় লাগবে।

পুলিশ জানায়, রোববার রাতে ঘটনার পর সারওয়ার আলীর বাসা থেকে নিরাপত্তাকর্মী হাসান ও গাড়িচালক হাফিজকে আটক করা হয়। মামলার পর দুজনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে গতকাল আদালতে হাজির করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুজনকে সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন করে পুলিশ। আদালত দুই দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

পুলিশের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র প্রথম আলোকে জানায়, বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী ও গাড়িচালক হামলার ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানেন না বলে দাবি করেছেন।

তবে পুলিশের ধারণা, সারওয়ার আলীর সাবেক গাড়িচালক নাজমুল হামলার ঘটনায় জড়িত। দুর্বৃত্তদের হামলার পর সারওয়ার আলীর বাসা থেকে যে ফোন পাওয়া যায়, সেটা নাজমুলের বলে শনাক্ত করা হয়েছে। তাঁকে গ্রেপ্তার করার চেষ্টা চলছে।

জানতে চাইলে উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তপন চন্দ্র সাহা প্রথম আলোকে বলেন, তদন্ত চলছে, নতুন কোনো তথ্য পাওয়া গেলে তা সবাইকে জানানো হবে।

অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান
ডা. সারওয়ার আলীকে সপরিবার হত্যার চেষ্টার নিন্দা জানিয়ে গতকাল যুক্ত বিবৃতি দিয়েছেন ২৪ জন বিশিষ্ট নাগরিক। তাঁরা অন্ধকারের অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য, মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সভাপতি জিয়াউদ্দিন তারিক আলী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আজিজুর রহমান, মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির প্রমুখ।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাঠানো ওই বিবৃতিতে বিশিষ্টজনেরা বলেন, এর আগেও যুদ্ধাপরাধী স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি বিভিন্ন পেশার চিন্তাশীল মানুষের তালিকা তৈরি করে হুমকি ও প্রাণনাশের ঘটনা ঘটিয়েছে। সারওয়ার আলীকে সপরিবার হত্যাচেষ্টা তারই ধারাবাহিকতার একটি অংশ। এই অপশক্তির দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গডফাদারদের খুঁজে বের করে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।

সারওয়ার আলী ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যাচেষ্টার প্রতিবাদে ১৩ জানুয়ারি বেলা তিনটায় জাতীয় জাদুঘরের সামনে নাগরিক প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে বলে বিবৃতিতে জানানো হয়েছে।

হামলাকারীদের শনাক্ত ও বিচারের দাবি
ডা. সারওয়ার আলীর বাড়িতে ঢুকে তাঁকে এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের ছুরিকাঘাত করে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিভিন্ন সংগঠন। হামলাকারীদের দ্রুত শনাক্ত এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে তারা। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো পৃথক বিবৃতিতে এই দাবি করা হয়।

সারওয়ার আলী ও তাঁর পরিবারের ওপর ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। এক বিবৃতিতে কমিটি বলেছে, জঙ্গি, মৌলবাদী, সন্ত্রাসবিরোধী অবস্থান নেওয়ার কারণে সারওয়ার আলীকে সপরিবার হত্যার উদ্দেশ্যে এই হামলা চালানো হয়েছে।

সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ ’৭১ হামলার ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার ও বিচারের মুখোমুখি করার দাবি করেছে।

ছায়ানট এক বিবৃতিতে সংগঠনটি বলেছে, ‘সারওয়ার আলী এবং তাঁর পরিবারের ওপর হামলা ও হত্যাচেষ্টায় আমরা ক্ষুব্ধ ও বিচলিত।’ বিবৃতিতে বলা হয়, এই হামলার তাঁর (সারওয়ার আলী) সকল মানবিক চর্চা স্তব্ধ করে দেওয়ার একটি ষড়যন্ত্র। হামলাকারী এবং এর সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবি জানিয়েছে ছায়ানট।

হামলাকারীদের দ্রুত শনাক্ত, সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে অপরাধীদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তির দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।

মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল এক বিবৃতিতে সারওয়ার আলী ও তাঁর পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এক বিবৃতিতে দ্রুততার সঙ্গে তদন্তের মাধ্যমে জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে।

এ ছাড়া সিপিবি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), ঐক্য ন্যাপ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, খেলাঘর, ডক্টরস ফর হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টসহ বিভিন্ন সংগঠন সারওয়ার আলী ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের প্রাণনাশের চেষ্টার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে।