ভোলায় টানা বৃষ্টিতে ফসলের বারোটা

ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার বড়মানিকা এলাকার আলুখেতে জমে থাকা বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন করছেন এক কৃষক। বৃষ্টির পানি জমে থাকায় পষেরর ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। গত রোববার তোলা।  ছবি: প্রথম আলো
ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার বড়মানিকা এলাকার আলুখেতে জমে থাকা বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন করছেন এক কৃষক। বৃষ্টির পানি জমে থাকায় পষেরর ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। গত রোববার তোলা। ছবি: প্রথম আলো

আলুখেতে প্রায় চার ঘনফুট গর্ত করা হয়েছে। ওই গর্ত থেকে বালতি দিয়ে পানি তোলা হচ্ছে। সেই পানি প্রায় ৩০-৪০ মিটার দূরে ফেলা হচ্ছে। এভাবে খেতে জমে থাকা বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন করছেন ভোলার সদর উপজেলার গুপ্তমুন্সি গ্রামের কৃষক মো. সিদ্দিকুর রহমান (৬৫)। তাঁর প্রায় দুই একর জমির আলু, খেসারি ও গম পানিতে তলিয়ে গেছে।

গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত থেকে শুক্রবার রাত পর্যন্ত প্রায় ২৪ ঘণ্টার টানা বৃষ্টিতে সিদ্দিকুর রহমানের মতো লাখো কৃষকের রবিশস্যের খেত পানিতে ডুবে গেছে। এই বৃষ্টির পানিতে ভোলার প্রায় ৩৩ হাজার ৪০৯ হেক্টর জমির রবিশস্য ও ধানের বীজতলা নিমজ্জিত হয়েছে।

গত সোমবার সকালে পানি নিষ্কাশনের সময় কৃষক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘এ্যান করি কী খ্যাতের পানি সরান যায়, যদি না নিজেত্তন স্যাঁত (দ্রুত) করি পানি নামি না যায় যে। পানি নাইমব ক্যামনে, দ্যাশের খাল-বিল সব শ্যাষ।’

ভোলা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একটি সূত্রে জানা গেছে, টানা তিন দিনের বৃষ্টিতে ভোলা সদর উপজেলার ৪ হাজার ৯৮৪ হেক্টর, দৌলতখান উপজেলার ২২, চরফ্যাশন উপজেলার ২০ হাজার ১৫০, বোরহানউদ্দিন উপজেলার ২ হাজার ১১০ হেক্টর, লালমোহন উপজেলার ৩ হাজার ৪৯৩, তজুমদ্দিন উপজেলার ২ হাজার ৪০০ এবং মনপুরা উপজেলার ২৫০ হেক্টর জমির ফসল আক্রান্ত হয়েছে। এসব খেতে বোরোর বীজতলা, আলু, মিষ্টি আলু, গম, ভুট্টা, তরমুজ, ফুট-ক্ষীরা, সরিষা, সয়াবিন, সূর্যমুখী, তিল, বাদাম, পেঁয়াজ, মরিচ, রসুন, ডাল ও শাকসবজি রয়েছে।

গত সোমবার ভোরের আলো ভালো করে না ফুটতেই কৃষকেরা কোদাল ও গামলা নিয়ে খেতে হাজির পানি নিষ্কাশনের জন্য। খেতের পাশে খেত। এক খেতের জমা পানি পাশের খেতে ফেলতে পারছেন না তাঁরা। ফেললেই ঝগড়া, হাতাহাতি। খেত শুকাচ্ছে, আবার খেতে পানি এসে জমা হচ্ছে। পানিনিষ্কাশনের আধুনিক ব্যবস্থা না থাকায় অনেক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

গুপ্তমুন্সি বিলের আলু কৃষক আবদুর রহিম (৪২)। তাঁর খেতে পানি জমে আছে। পাঁচজন শ্রমিক নিয়ে রোববার থেকে পানি নিষ্কাশনের আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। তিনি দুই একর জমিতে আলু, ১ একর জমিতে করল্লা, ৮০ শতাংশে খেসারি ডাল আবাদ করেছেন। সব মিলিয়ে তিনি সাড়ে তিন লাখ টাকার ক্ষতির আশঙ্কা করছেন।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘এই লইয়া তিন বছর পরপর আলুত লছ (ক্ষতি) দিতাছি; দায়দ্যানা বাড়তেই আছে। এইবার সব শ্যাষ, পলাই যাওন ছাড়া উপায় নাই।’

গুপ্তমুন্সি বিলের ১২ জন কৃষক বলেন, বিলজুড়ে আলু, গম, সরিষা, বাদাম, মসুর, খেসারি, মরিচ, বিভিন্ন জাতের সবজি, প্লেন ডালসহ নানা রকম রবিশস্যের আবাদ হয়েছে। ২৪ ঘণ্টার টানা বৃষ্টিতে ডোবা-খেত তলিয়ে আছে। গত তিন দিনেও (শনি-সোমবার) শুকায়নি। দ্রুত পানি না সরাতে পারলে খেতে ৫০-৮০ শতাংশ ফসলের ক্ষতি হবে।

তবে গুপ্তমুন্সি ব্লকের ব্লক সুপারভাইজার (ইউনিয়ন উপসহকারী কর্মকর্তা) মিলন চন্দ্র দে বলেন, তাঁর ব্লকে ৮০০ হেক্টর ফসলি জমি আছে। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ জমি পানিতে ডুবেছে। ৩-৪ দিন না যেতে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা সম্ভব নয়।

ভোলা সদর উপজেলার ভেদুরিয়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের চরকালি বিলের কৃষক মোশারেফ হোসেন বলেন, তাঁদের চরকালি বিলের ৮০ ভাগ জমিতে পানি জমে আছে। খেতের সরিষা, গম, আলুসহ বিভিন্ন জাতের ডালের বীজ ও গাছ পানির নিচে। পানি শুকাতে শুকাতে রবি মৌসুম শেষ হবে।

ভোলার দৌলতখান উপজেলার মদনপুরে ইউনিয়নের ইউপি সদস্য মো. ফারুক দৌলত বলেন, ইউনিয়নের কৃষকের ধান, সবজি ও সয়াবিনের ক্ষতি হয়েছে। কৃষক সময়মতো সয়াবিন আবাদ করতে পারবেন না।

ইউনিয়নের চর টবগি ব্লকের ব্লক সুপারভাইজার বেনজির আহাম্মদ বলেন, তাঁর ব্লকে ২০ হেক্টর জমির সবজির ক্ষতি হবে।

ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার বড়মানিকা ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের আলুচাষি এরশাদ আলী জানান, তিনি ঋণ নিয়ে দুই একর জমিতে আলুর আবাদ করেছেন। সবটুকুই পানিতে নিমজ্জিত।

একই ইউনিয়নের আলুচাষি হেলালউদ্দিন, জাহাঙ্গীর আলম, মো. এছহাক মিয়া, হোসেন খন্দকার, মো. হোসেন মোল্লা, দেলোয়ার হোসেন মিয়া, আবদুল মালেক, মো. নকিব, শহিদ রাড়ি জানান, তাঁদের ১৪ একর আলুখেতের একই অবস্থা। তিন ধরে খেতে জমা পানি নিষ্কাশনের চেষ্টা করছেন।

একই অবস্থা উপজেলার কুতুবা ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের আলুচাষিদের। এ ইউনিয়নের চরলক্ষ্মী গ্রামের কৃষক অহিদ সরদার বলেন, তাঁর ১ একর জমির মটর, ৪০ শতাংশের গম, ৫০ শতাংশের খেসারি ও ৭৭ শতাংশের পেঁয়াজ এখনো পানির নিচে।

চরফ্যাশন উপজেলার আদর্শ কৃষক সমিতির পরিচালক মো. ফারুকুর রহমান বলেন, বৃষ্টির পানিতে নিমজ্জিত খেতের ৮০ ভাগ ফসল ও বীজতলা নষ্ট হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ভোলার সাত উপজেলার শতাধিক কৃষকের ভাষ্য, খেতে অসময়ে বৃষ্টির পানি জমে যাওয়ার কারণে বীজ অঙ্কুরোদ্‌গমের আগে বীজতলার বীজ ও ফসলের মূলে পচন ধরেছে। একরপ্রতি ফসলের ক্ষতি দাঁড়াবে ১০ হাজার টাকা থেকে দেড় লাখ টাকা।

ভোলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিনয় কৃষ্ণ দেবনাথ বলেন, ‘অামরা ফসলের ক্ষয়ক্ষতির জরিপ এখনো করিনি। সপ্তাহ শেষে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। জরিপ না করে ক্ষতি নিরূপণ করা যাবে না।’