এলোমেলো অবস্থা থেকে এখনো বের হতে পারেনি বিএনপি

>নতুন বছরেও বড় কোনো পরিকল্পনা নেই। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান চেষ্টা করছেন দলকে তাঁর মতো গোছাতে।

অসংগঠিত ও এলোমেলো অবস্থায় একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল বিএনপি। এখনো সেই অবস্থা থেকে বের হতে পারেনি দলটি। না ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনার আন্দোলন, না দলীয় প্রধান খালেদা জিয়ার কারামুক্তি—কোনোটারই কিনারা করতে পারেনি দলটি। বরং ২০১৯ সালজুড়েই গোলকধাঁধায় ছিলেন নেতা-কর্মীরা।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। তার আগের রাতেই ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করার অভিযোগ এনে বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ওই নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান এবং জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছিল। একই সঙ্গে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে মুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছিল।

কিন্তু ভোটের পর বিএনপি হয়ে পড়ে আরও এলোমেলো। প্রথমে ফল প্রত্যাখ্যান করে সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে বিএনপির প্রার্থীরা নির্বাচন বাতিল চেয়ে ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। এই সিদ্ধান্ত অমান্য করে একজন সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেওয়ায় তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। চার মাসের মাথায় দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়া নির্বাচিত সব সাংসদ শপথ নেন। মির্জা ফখরুল কেন শপথ নিলেন না, তা এখনো নেতা-কর্মীদের কাছে রহস্য হয়ে রয়েছে। বিএনপির নেতা-কর্মীদের অনেকে বলছেন, নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যানের পর দলীয় সাংসদদের শপথ নেওয়া নিয়ে যে গোলকধাঁধার সৃষ্টি হয়, এখনো সেখানেই ঘুরপাক খাচ্ছে দলটি।

অবশ্য বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে যে ফ্যাসিস্ট চরিত্র ধারণ করেছে, এমন প্রেক্ষাপটে জনগণের কাঙ্ক্ষিত আন্দোলন গড়ে তোলা অনেক সময় সম্ভব হয় না। তবে জনগণ সুযোগ পেলেই ঘুরে দাঁড়াবে।

প্রায় তিন বছর ধরে দল গোছানোর কথা বললেও এখন পর্যন্ত সব জেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে পারেনি। ৪০টি সাংগঠনিক জেলায় আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর পুনর্গঠন হয়নি। এর মধ্যে ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা এবং নানামুখী চাপের কারণে নেতা-কর্মীদের একটা অংশ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান ও ভাইস চেয়ারম্যান এম মোরশেদ খান দল ছেড়েছেন।

অবশ্য বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা বেরিয়ে গেছেন, তাঁদের মামলা-মোকদ্দমাসহ ব্যক্তিগত সমস্যা আছে। তিনি দাবি করেন, এত বিপদ ও এত মামলার পরেও সারা দেশে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে অটুট আছে। এ ছাড়া ভোটের আগের রাতের সিল মারাসহ সরকারের ব্যর্থতা ও লুটপাটের বিষয়গুলো তাঁরা জনগণকে বোঝাতে পেরেছেন। জনগণ যখন সুযোগ পাবে, তখন বোঝা যাবে বিএনপি কতটা জনপ্রিয় দল।

বিএনপির একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, নতুন বছরেও সরকারবিরোধী বড় আন্দোলনে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই। খালেদা জিয়ার অবর্তমানে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান চেষ্টা করছেন দলকে তাঁর মতো গোছাতে। সে অনুযায়ী সাংগঠনিক কমিটি দিচ্ছেন। যদিও সারা দেশে বিএনপির সাংগঠনিক কমিটি গঠন ও নীতিনির্ধারণী বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে দলে অস্বস্তি আছে। গত জুনে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্ষদ স্থায়ী কমিটিতে সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ নিয়ে অনেকে মনঃক্ষুণ্ন। অনেকের ধারণায় ছিল স্থায়ী কমিটিতে জ্যেষ্ঠ নেতা হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, আবদুল্লাহ আল নোমান ও শাহ মোয়াজ্জেম, খন্দকার মাহবুব হোসেন, আবদুল আউয়াল মিন্টুর মধ্য থেকে কাউকে করা হতে পারে।

নেতা-কর্মীদের অনেকে মনে করেন, গত এক বছরে বিএনপির সাংগঠনিক সফলতা বলতে একটিই। তা হচ্ছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠান। আদালতের নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই ১৮ অক্টোবর রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের শাহজাহানপুরের বাড়িতে এই সম্মেলন হয়। কাউন্সিলরদের সরাসরি ভোটে ছাত্রদলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

গত বছরের বিএনপির সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, দলটি খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে সাদামাটা কর্মসূচিতেই কাটিয়েছে। যদিও বছর শেষে দলের একটি অংশকে খালেদা জিয়ার জামিন নিয়ে তৎপর হতে দেখা যায়। তবে এতে বিপরীত ফল হয়। উল্টো তিনটি মোটরসাইকেল পোড়ানোর মামলায় আসামি হন মহাসচিবসহ ৫০০ নেতা-কর্মী।

বিএনপির রাজনীতির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আসিফ নজরুল বলেন, বিএনপিকে একটা বিরূপ পরিস্থিতিতে রাজনীতি করতে হচ্ছে। বিরোধী দলের এত নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে এত মামলা, এত গুম, খুন, নির্যাতনের ঘটনা আগে দেখা যায়নি। বিএনপির প্রধান নেতা জেলে, বিকল্প নেতা দেশের বাইরে, তাঁর বক্তব্য প্রচারেরও কোনো সুযোগ নেই। এই পরিস্থিতিতে বিএনপি কী কর্মপদ্ধতি নেবে, সেটা তারা খুঁজে বের করতে পারছে না। সম্ভবত জ্যেষ্ঠ নেতৃত্বের মধ্যে সমন্বয় এবং কৌশলী চিন্তারও কিছুটা অভাব আছে।