ক্লাবপাড়ায় ক্যাসিনো বন্ধ, চাঁদাবাজির হাতবদল

>
ক্লাবপাড়ার হাজী বিল্ডিং থেকে এখনো চাঁদা তুলছেন নেতারা। ভবনটি যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের সহযোগীদের দখলে। গত সোমবার রাজধানীর আরামবাগ এলাকায়।  ছবি: প্রথম আলো
ক্লাবপাড়ার হাজী বিল্ডিং থেকে এখনো চাঁদা তুলছেন নেতারা। ভবনটি যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের সহযোগীদের দখলে। গত সোমবার রাজধানীর আরামবাগ এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো
ক্লাবগুলোতে তালা, ভাড়া উঠছে দোকান থেকে। খেলাধুলার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।

ক্যাসিনো কারবার করে অঢেল সম্পদের মালিক হলেও এলাকাবাসীর অভিযোগ, ঢাকা মহানগর যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাট, তাঁর সহযোগী সাবেক কাউন্সিলর মমিনুল হক সাঈদ ও সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া একসময় চাঁদাবাজির পয়সায় চলতেন। শুদ্ধি অভিযানে মতিঝিলের ক্লাবপাড়ার ক্যাসিনোগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। আড়ালে থাকছেন নেতারা। কিন্তু জারি রয়েছে চাঁদাবাজি, দখলদারির পুরোনো নেটওয়ার্ক।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে মতিঝিল–আরামবাগের মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব, মোহামেডান ক্লাব, ফকিরেরপুল ইয়ংমেনস ক্লাব, ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, ভিক্টোরিয়া, আরামবাগ ক্লাবে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান চালানো হয়। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে ক্লাবপাড়া ঘুরে, আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের কমপক্ষে ছয়জন সদস্য ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্লাবের তালাটা শুধু বন্ধ আছে। বাকি সব চলছে আগের মতোই। নেতৃত্বে এসেছেন অন্যরা। তাঁরা মমিনুল হক সাঈদের চার সহযোগী ৯ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক মো. হাসান উদ্দীন জামাল, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান, দিলকুশা ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান ও মতিঝিল থানা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসানের নাম বলেছেন। 

পরিত্যক্ত ভবন, ক্লাবের নিয়ন্ত্রণাধীন দোকানপাট, ফুটপাতের চাঁদা, অবৈধ মার্কেট এখন তাঁদের নিয়ন্ত্রণে। পরিত্যক্ত যে ভবনটি যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের সহযোগীদের দখলে, সেটির নাম হাজী বিল্ডিং। নয়তলা এই ভবনটিতে ফ্ল্যাট সংখ্যা ১১০। প্রতিটি কক্ষের ভাড়া পাঁচ থেকে আট হাজার টাকা। নাম না প্রকাশ করার শর্তে স্থানীয় বাসিন্দারা প্রথম আলোকে বলেন, মমিনুল হকের সহযোগী তাহের সরকার প্রথমে এই ভবনের নিচতলার একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে ছাপাখানা দিয়েছিলেন। ভবনটির মালিক যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলী। তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার পর ওই ভবন পরিচালনার সঙ্গে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের আর দেখা যায়নি। মমিনুল হক কাউন্সিলর হিসেবে শপথ নেন ২০১৬ সালের ৬ মে। ওই মাসেই তিনি তাহের সরকারকে নিয়ে ভবনটি দখল করেন। তখন থেকে ওই ভবনের অঘোষিত মালিক তিনি। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পর ভবনটির নিয়ন্ত্রণ নেন মো. হাসানউদ্দিন জামাল। তিনি যুবলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক হলেও তিনি ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) যুবলীগের স্বঘোষিত ভারপ্রাপ্ত সভাপতি।

হাসানউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, মমিনুল হক বিদেশে যাওয়ার পর থেকে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান আর দিলকুশা ক্লাব পরিচালনায় যুক্ত একজন ওখান থেকে টাকা তুলছেন। ফুটপাতের টাকাপয়সা তোলেন লাইনম্যানরা (পুলিশের নিয়োগকৃত লোকজন)।

বাংলাদেশ অবজারভার ও সোনালী ব্যাংকের পেছনে শতাধিক দোকানপাট আছে। অবজারভার–এর পেছনে মূলত খাবার হোটেল, ফটোকপি, মোবাইলভিত্তিক আর্থিক সেবাদানের প্রতিষ্ঠান। প্রতিদিন এখানে কয়েক শ মানুষ খান। ওই এলাকায় জন্ম ও বেড়ে উঠেছেন এমন এক ব্যক্তি প্রথম আলোকে বলেন, বছর পাঁচেক আগে চালু হওয়া দোকানগুলোর প্রতিটি থেকে পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা তোলা হয়। এই অংশও নিয়ন্ত্রণ করেন হাসানউদ্দিন জামাল। কাছেই সোনালী ব্যাংকের পেছনে জুতা, ফটোকপি, পর্দা, মোবাইলভিত্তিক আর্থিক সেবাদানের প্রতিষ্ঠান, খাবার হোটেলসহ ৫০টির বেশি দোকান নিয়ে একটা বিপণিবিতান গড়ে উঠেছে। একটা সময় লালমিয়া নামে এক ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে ছিল অঞ্চলটি। পরে তাঁকে সরিয়ে মমিনুল হক দখল নেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে এখান থেকে মাসোহারা নেন মতিঝিল থানা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান। তিনি এলাকায় ভাগনা হাসান নামে পরিচিত। স্থানীয় লোকজন জানান, এই হাসান মমিনুল হকের ভাগনে। দৈনিক বাংলা থেকে বাংলার বাণী (পেট্রলপাম্প) পর্যন্ত এবং শাপলা চত্বর থেকে ইউনুস সেন্টার পর্যন্ত ফুটপাতের চাঁদা তোলার অভিযোগও আছে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে। 

এ বিষয়ে জানতে মাহমুদুল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁর ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পাওয়া যায়নি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমানকেও। 

আর মতিঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইয়াসির আরাফাত প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা নিয়মিত উচ্ছেদ করি। মতিঝিল বড় এলাকা। আপনারা সবই বোঝেন। এর চেয়ে বেশি কিছু বলার নেই।’

 ক্লাবে তালা, ভাড়া উঠছে দোকান থেকে
সেপ্টেম্বরে শুদ্ধি অভিযানে ক্যাসিনো কারবারের অভিযোগে ক্লাবগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। শুধু মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব লিমিটেডের কার্যক্রম চলছে। ক্লাবের মূল ফটকে ‘জাগো, মোহামেডান জাগো’ লেখা ব্যানার ঝুলতে দেখা গেছে। ক্লাবের ভেতরকার মাঠে শিশুদের নিয়মিত ক্রিকেট কোচিং চলছে। প্রিমিয়ার লিগের জন্য দলও গড়েছে মোহামেডান। আরামবাগ ক্লাবের ফটকে তালা ঝুললেও ক্লাব কর্তৃপক্ষ দল গঠন করেছে। ক্লাবটির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইয়াকুব আলী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা শেষ মুহূর্তে দল গঠন করেছেন। কমলাপুর স্টেডিয়ামে খেলোয়াড়েরা থাকছেন। নিজেদের ক্লাবে ঢুকতে পারছেন না। কোনো কোনো খেলোয়াড়কে আগে অগ্রিম টাকা দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের কাছ থেকে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) মাধ্যমে টাকাটা ফেরত নেওয়া হয়েছে।

ক্লাবগুলো অর্থাভাবে ভুগলেও ক্লাবের মালিকানাধীন দোকানপাটের ভাড়া তোলা হচ্ছে। কিন্তু এই ভাড়া কোথায় কোন তহবিলে জমা হচ্ছে, কেউ জানে না।

উল্লেখ্য, ফকিরেরপুল ইয়ংমেনস ক্লাব ছাড়া প্রতিটি ক্লাবেরই মালিকানাধীন দোকান রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের মালিকানাধীন ৩৩টি, আরামবাগের মালিকানাধীন ৩০–৪০টি ও দিলকুশা ক্লাবের মালিকানাধীন ২৫–৩০টি দোকান আছে। ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের মালিকানাধীন যেসব দোকান অগ্রিম ভাড়া দিয়ে রেখেছিল, সেগুলো বাদে বাকি দোকানগুলো থেকে ভাড়া তোলা হচ্ছে। ক্লাবপাড়ায় ভাতের হোটেল চালান এমন একজন ব্যবসায়ী প্রথম আলোকে বলেন, প্রথমে তিনি আড়াই লাখ টাকা অগ্রিম শোধ করে আরামবাগ ক্লাবের মালিকানাধীন একটি দোকানে হোটেল খুলেছিলেন। জুয়ার বোর্ড (ওয়ান–টেন) চালানোর জন্য আরামবাগ ক্লাব কর্তৃপক্ষ দোকান ভেঙে দেয়। এখন নতুন করে একটি ভাতের হোটেল দিয়েছেন, প্রতি মাসে দিলকুশা ক্লাবের লোকজনকে টাকা দেন। ক্লাবের মালিকানাধীন দোকানপাটের টাকা কোথায় জমা হচ্ছে, সে সম্পর্কে তাঁরা জানেন না।

 খেলাধুলার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত
কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের অনুমোদন বাতিল করেছে সমাজসেবা অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকা জেলা অফিস থেকে প্রতিনিধিদল গিয়ে ক্লাবটির বিরুদ্ধে ক্যাসিনো পরিচালনায় যুক্ততার প্রমাণ পেয়েছে। সে কারণে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কলাবাগান ক্রীড়া চক্রে গিয়ে ক্লাব কর্মকর্তাদের কাউকে পাওয়া যায়নি। কথা হয় ক্লাবটির তৃতীয় বিভাগে খেলা দল সবুজবাংলার কোচ মো. রুবেলের সঙ্গে। তিনি বলেন, কলাবাগান ক্রীড়া চক্রে ক্যাসিনো বহু আগে বন্ধ হয়েছে। তারপরও কেন অনুমোদন বাতিল করা হলো, তাঁরা বুঝতে পারছেন না। 

এদিকে মতিঝিলের ক্লাবপাড়া সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ক্লাব কর্তৃপক্ষ কক্ষ ভাড়া দিয়ে ওয়ান–টেন, ক্যাসিনো চলার সুযোগ করে দিলেও তা থেকে ক্লাব কর্তৃপক্ষ খুব একটা লাভবান হয়নি। অনেক ক্লাবেরই কক্ষ ভাড়া বাকি রয়ে গেছে। যুবলীগ নেতারা চাঁদার টাকাটা শুধু তুলে নিয়ে গেছেন। আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের নেতা–কর্মীরাই বলেছেন, আরামবাগে দুটি বোর্ড থেকে প্রতিদিন সাত লাখ টাকা, মোহামেডান থেকে পাঁচ লাখ, ভিক্টোরিয়া থেকে চার লাখ, দিলকুশা থেকে পাঁচ লাখ, ফকিরাপুল থেকে পাঁচ লাখ টাকা উঠত। ওয়ান্ডারার্স ক্লাব এনু–রূপন চালালেও প্রতিদিন দুই লাখ টাকা সম্রাটকে বুঝিয়ে দিতেন। ক্যাসিনোর টাকায় খেলাধুলার কাজ হয়েছে, এমনটা কেউ নিশ্চিত করতে পারছেন না।

ফকিরেরপুল ইয়ংমেনস ক্লাবের সাবেক সভাপতি নাসিরুদ্দীন মল্লিক (পিন্টু)। তাঁর মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে ক্লাবের দখল নিয়ে ক্যাসিনো চালু করেছিলেন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। ক্রীড়াসংগঠক এই ব্যক্তি প্রথম আলোকে বলেন, যেভাবেই হোক ক্লাবগুলোকে রাহুমুক্ত করে চালু করতে হবে। ক্লাবের তালা খুলে না দিলে খেলোয়াড়েরা কোথায় যাবেন?