'ঘটনার পেছনের ঘটনা' উদ্ঘাটনে তদন্ত কমিশন গঠনের সুপারিশ

পিলখানা হত্যাকাণ্ড
পিলখানা হত্যাকাণ্ড

পিলখানা হত্যা মামলার অন্যতম রায়দানকারী বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী তাঁর দীর্ঘ রায়ে ‘ঘটনার পেছনের ঘটনা’ উদ্‌ঘাটনে একটি তদন্ত কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছেন।

বিচারপতি মো. শওকত হোসেন, বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর রায় দিয়েছিলেন। রায় ঘোষণার দুই বছরের বেশি সময় পর আজ বুধবার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলো। ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ের মধ্যে ১৬ হাজার ৫৫২ পাতার রায় লিখেছেন বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী। তিনি তাঁর রায়ে ১১ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন।

হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চের বিচারপতিরা পিলখানা হত্যা মামলায় ১৩৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন, ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড ও অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ড ও সাজা বহালের সিদ্ধান্তে একমত পোষণ করে রায় দেন।

পিলখানা হত্যা মামলার ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় বুধবার। ছবি: প্রথম আলো
পিলখানা হত্যা মামলার ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় বুধবার। ছবি: প্রথম আলো

বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকীর রায়ে ১১ দফা নির্দেশনা তুলে ধরা হলো:

১. (ক) বাংলাদেশ রাইফেলসের নিরাপত্তাবিষয়ক ইউনিট (আরএসইউ) বিজিবির মেধাবী, সৎ ও চৌকস সদস্যের সমন্বয়ে নতুনভাবে ঢেলে সাজানো এবং ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে দায়িত্বে অবহেলার জন্যে ঘটনাকালীন দায়িত্বে থাকা আরএসইউর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। (খ) ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে বাংলাদেশ রাইফেলসের মহাপরিচালকের দরবারে সশস্ত্র আক্রমণ এবং পিলখানায় মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পূর্বাভাস সংগ্রহে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থতার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থাসহ দায়িত্বে অবহেলাকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

২. (ক) মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে পিলখানায় বাংলাদেশ রাইফেলসের কুচকাওয়াজে সালাম গ্রহণ করেছেন, অথচ সরকারের সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা বাহিনী ও নিরাপত্তা কর্মীদের বাহ্যিক তৎপরতা দৃশ্যমান হলেও ভেতরে অন্তঃসারশূন্যতা পরিলক্ষিত হয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের অধিকতর সতর্ক করা। (খ) বিডিআরে তীব্র অসন্তোষ এবং প্রকাশ্যে লিফলেট বিতরণ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতাসহ কমান্ডিং অফিসারদের নজরে আসা সত্ত্বেও তাঁরা উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করে উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছেন। ভবিষ্যতের জন্য সংশ্লিষ্টদের মনোযোগী ও সতর্ক হওয়া।

৩. (ক) মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন মেধাবী, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, দক্ষ, ত্বরিত ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে পারদর্শী, উপযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে থেকে বিজিবির মহাপরিচালকসহ অন্য কর্মকর্তাদের প্রেষণে নিয়োগের কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা। (খ) বিজিবির অফিসারসহ সব পদের সদস্যদের মানবিক গুণাবলি, দায়িত্ব, কর্তব্য, বিভাগীয় আইন ও শৃঙ্খলা–সম্পর্কিত প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

৪. (ক) সামরিক/বেসামরিক কর্মকর্তাদের ব্রিটিশ আমলের আমলাতান্ত্রিক মনোভাব পরিহার করে সবাইকে সেবার মানসিকতা নিয়ে দেশপ্রেমের সঙ্গে কাজ করার প্রশিক্ষণ প্রদান করা। (খ) ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়া এবং বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সংগ্রামে পেশা, পদবি, সামাজিক পরিচয়কে প্রাধান্য না দিয়ে সংবিধানে উল্লিখিত মূলনীতি অনুসরণ করে সবার প্রতি মানবিক আচরণ ও সম্মান প্রদর্শনের মানসিকতায় বাহিনীকে গড়ে তোলা।

৫. (ক) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বিজিবিসহ অধীনস্থ সব বাহিনীর সদস্যদের সুবিধা ও অসুবিধা–সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ে আন্তরিকতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা। (খ) বাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টির পূর্বেই কর্তৃপক্ষকে আইনসম্মত ও সম্মানজনক উপায়ে তার সমাধান খুঁজে বের করা।

৬. (ক) বিজিবিসহ অন্যান্য বাহিনীর মধ্যে চাকরিবিধি মতে মর্যাদার পার্থক্য যত দূর সম্ভব কমিয়ে আনা এবং সবাইকে সংবিধানসম্মত উপায়ে আইনানুগভাবে সম্মানের সঙ্গে প্রজাতন্ত্রের চাকরি করার সুযোগ সৃষ্টি করা । (খ) বিজিবি সদস্যদের পদোন্নতি, বেতন, ভাতা, রেশন, ছুটি, আবাসিক সমস্যা, চিকিৎসা ও সন্তানদের শিক্ষা গ্রহণের সুবিধাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে উদ্ভূত সমস্যা দ্রুত সমাধানে মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সময়োপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

৭. (ক) আইনানুগ কোনো বাধা না থাকলে অন্যান্য বাহিনীর ন্যায় বিজিবি সদস্যদের জাতিসংঘে শান্তি মিশনে অংশগ্রহণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। (খ) বাহিনীর প্রতিটি সদস্যের প্রতি সম আচরণ করা। দায়িত্বপ্রাপ্ত কমান্ডিং অফিসার কর্তৃক অধীনস্থদের প্রতি আত্মমর্যাদাহানিকর যেকোনো আচরণ থেকে বিরত থাকা, কারণ তাঁরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী।

৮. (ক) ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে পিলখানায় নিহত সামরিক, আধা সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তির পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করা। (খ) সেনা কর্মকর্তাসহ নিহত ব্যক্তিদের সন্তান বা পরিবারের উপযুক্ত সদস্যদের আর্থিক, সামাজিক ও পারিবারিক নিরাপত্তা বিধানে যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরির ব্যবস্থা গ্রহণ করা। (গ) সামরিক কর্মকর্তাসহ নিহত ব্যক্তিদের সম্মানে পিলখানাসহ দেশের সব সেনানিবাস, বিজিবির সব সেক্টর হেডকোয়ার্টারে নামফলক নির্মাণ করা।

৯. (ক) পুনর্গঠিত বিজিবি সংবিধান ও নেতৃত্বের প্রতি অবিচল আস্থা রেখে দেশের সীমান্ত রক্ষাসহ তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পেশাদার বাহিনী হিসেবে দেশপ্রেম, সততা ও শৃঙ্খলার সঙ্গে পালনের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে বিজিবির হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা। (খ) দেশের সীমান্তরক্ষী হিসেবে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রাথমিক নিরাপত্তা বাহিনীর (ফার্স্ট ডিফেন্স ফোর্স) দায়িত্বে থাকা বিজিবিকে শক্তিশালী বাহিনী রূপে গড়ে তোলার কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

১০. (ক) সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র‍্যাবসহ অন্যান্য বাহিনীকে ‘অপারেশন ডাল-ভাতের’ ন্যায় অন্য কোনো আর্থিক কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করার সিদ্ধান্ত পরিহার করা। আর্থিক লেনদেন ও লাভ-ক্ষতির হিসাব–নিকাশ বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে অহেতুক বিভেদ ও নৈতিক স্খলনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ রাইফেলসের ক্ষেত্রে ‘অপারেশন ডাল–ভাত’ উৎকৃষ্ট উদাহরণ। (খ) পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ‘ঘটনার পেছনের ঘটনা’ উদ্‌ঘাটন করে জাতির সামনে প্রকৃত স্বার্থান্বেষী মহলের চেহারা উন্মোচনের জন্য জনস্বার্থে সরকার প্রয়োজন মনে করলে আইনানুগভাবে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের দ্বারা তদন্ত কমিশন গঠনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

১১. (ক) সমাজের সব স্তরে নৈতিকতা পুনরুদ্ধার ও জাতি গঠনের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষায় বাধ্যতামূলক নীতিশাস্ত্র (এথিকস) শিক্ষাদান অতি জরুরি। নৈতিকতার অবক্ষয়ের কারণে সমাজের প্রতিটি স্তরে অসম প্রতিযোগিতা দৃশ্যমান। আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় নীতিশাস্ত্রের অধ্যয়ন বাধ্যতামূলক হওয়া অপরিহার্য। (খ) রাষ্ট্র ও সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বসবাস উপযোগী উন্নত ও টেকসই সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য নিজ নিজ ধর্মীয় ও পারিবারিক অনুশাসনে শিশুদের চরিত্র গঠনের মাধ্যমে মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার বিশুদ্ধ পরিবেশ সৃষ্টি করা উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

রায়ের উপসংহারে বলা হয়, অত্র রায়ে ব্যবহারিক ও প্রায়োগিক আইনের ব্যাখ্যা, পর্যালোচনাসহ ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড, ১৮৫ জনের যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড, অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা ও খালাসপ্রাপ্ত সব আপিলকারীর মামলা পৃথক পৃথক পর্যবেক্ষণে নিষ্পত্তি করা হয়েছে।

২০১৭ সালের ২৬ নভেম্বর হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. শওকত হোসেন সংক্ষিপ্ত সূচনা বক্তব্যের পর জনাকীর্ণ আদালতে বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী সারা দিনব্যাপী নজিরবিহীন এই মামলায় সুদীর্ঘ পর্যবেক্ষণ দেন। পরদিন অপর বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের পর্যবেক্ষণ শেষে তিনজন বিচারপতি পর্যায়ক্রমে দণ্ড ও সাজার আদেশ ঘোষণা করেন।

বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকীর বাংলায় লেখা ১৬ হাজার ৫৫২ পাতার রায়ে মামলার প্রেক্ষাপট, ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা ও নৃশংসতার সচিত্র পর্যবেক্ষণ, প্রায়োগিক ও ব্যবহারিক আইনের প্রয়োগ ও যৌক্তিক বিশ্লেষণের সঙ্গে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার একমত পোষণ করেছেন।

বিচারপতি সিদ্দিকীর সম্পাদিত রায়টি বিশ্বের বিচার বিভাগের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ হিসেবে একটি নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকীর লেখা যুগান্তকারী এই রায়ের দীর্ঘ পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশ রাইফেলসের ২১৮ বছরের বর্ণাঢ্য ইতিহাস, মহান মুক্তিযুদ্ধে এই বাহিনীর অবদান, সেনা অফিসারদের নেতৃত্বের প্রতি বাহিনীর অসন্তোষ, বিদ্রোহের প্রেক্ষাপট, ঘটনাস্থলের পারিপার্শ্বিক অবস্থা, ঘটনার নৃশংসতা, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি বিদ্রোহীদের প্রকাশ্য হুমকি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা, বিদ্রোহের লক্ষ্য, ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৪৮ দিনের নবগঠিত সরকারের প্রতি প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ, বিদ্রোহের পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র, স্বার্থান্বেষী মহলের উসকানি, ঘটনার পেছনের ঘটনা, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নজিরবিহীন মামলাটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা নিয়ে তিনি গবেষণামূলক সুদীর্ঘ পর্যবেক্ষণ প্রদান করেছেন।

মামলার বিশালতা, ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ বিশেষ করে দণ্ড ও সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও তাঁদের পরিবারের সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট সবার সহজে বোঝার বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে তিনি রায়টি বাংলায় লিখেছেন।

ঐতিহ্য ও বীরত্বগাথা:
আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, ‘২১৮ বছরের অধিককালের ঐতিহ্যবাহী আধা সামরিক বাহিনী হিসেবে বিডিআরের নেতৃত্ব শুরু থেকেই সেনাবাহিনীর হাতে ছিল। ফলে সাধারণ জওয়ান ও সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে মর্যাদা, শৃঙ্খলা ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে ক্রমান্বয়ে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। ফলে বিডিআর সদস্যদের মধ্যে সেনা অফিসারদের কর্তৃত্ব মেনে না নেওয়ার এক প্রচ্ছন্ন মানসিকতা নীরবে সক্রিয় ছিল। উপরন্তু ওই ঔদ্ধত্যপূর্ণ মানসিকতায় পুষ্ট হয়ে বাংলাদেশ রাইফেলসের বিভাগীয় কতিপয় উচ্চাভিলাষী সদস্য ও একটি স্বার্থান্বেষী মহলের প্ররোচনা ও উসকানিতে সাধারণ ও নবাগত সৈনিকগণ প্ররোচিত ও বিভ্রান্ত হয়ে একই উদ্দেশ্যে বিদ্রোহে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে তারা হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ ও পাশবিক অত্যাচার চালিয়েছে।’

বাংলাদেশ বিলুপ্ত বাংলাদেশ রাইফেলসের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়েছে, ‘মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরে সামান্য সংখ্যক প্রাচীন অস্ত্র নিয়ে তৎকালীন ইপিআর বাহিনী এক অসামান্য ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে। আধা সামরিক বাহিনী হয়ে ইপিআরের বীর সৈনিকবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ বীরত্ব ও সুমহান আত্মত্যাগের ইতিহাস রচনা করে জাতিকে গৌরবান্বিত করেছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ইপিআরের সাড়ে ১২ হাজার বাঙালি সৈনিক সরাসরি অংশগ্রহণ করে, অপরিসীম বীরত্বের জন্য শহীদ ল্যান্স নায়েক মুন্সি আব্দুর রউফকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব “বীরশ্রেষ্ঠ” পদক প্রদান করা হয়। এ ছাড়া এ বাহিনীর ৮ জন বীর উত্তম, ৩২ জন বীর বিক্রম ও ৭৮ জন বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত হয়। মুক্তিযুদ্ধে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের ৮১৭ জন বাঙালি সৈনিক (বীর মুক্তিযোদ্ধা) শহীদ হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ইপিআর বাহিনীর বাঙালি সৈনিকদের অপরিসীম সাহস, দৃঢ় মনোবল, দেশপ্রেম ও চরম আত্মত্যাগ বাঙালি জাতি তথা সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। দেশমাতৃকার সেবায় পরিবর্তিত বিজিবির সৈনিকেরা ভবিষ্যতেও থাকবে নিবেদিতপ্রাণ, সাহসী ও আত্মপ্রত্যয়ী, জাতি এটাই প্রত্যাশা করে।’

রায়ে পিলখানা বিদ্রোহের নেতৃত্বদানকারী ডিএডি তৌহিদ সম্পর্কে বলা হয়, ‘তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান জাতি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে। পাশাপাশি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অতন্দ্রপ্রহরী সশস্ত্র বাহিনীর ৫৭ জন মেধাবী অফিসারসহ ৭৪ জন নিরস্ত্র ব্যক্তিকে নির্মম ও বর্বরোচিতভাবে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকা প্রমাণিত হলে দেশের প্রচলিত আইনে শাস্তি হবে, এটাই আইনের বিধান, কারণ কেহই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।’

পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়েছে, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশ, র‍্যাবসহ সবাই আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে শ্বাসরুদ্ধকর ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে।

বিচারপতি সিদ্দিকী বিদ্রোহীদের আটটি মূল লক্ষ্য ছিল বলে উল্লেখ করেন। ১. সেনা কর্মকর্তাদের জিম্মি করে যেকোনো মূল্যে দাবি আদায় করা, ২. বাহিনীর চেইন অব কমান্ড ধ্বংস করে এই সুশৃঙ্খল বাহিনীকে অকার্যকর করা। ৩. প্রয়োজনে সেনা কর্মকর্তাদের নৃশংসভাবে নির্যাতন ও হত্যার মাধ্যমে ভবিষ্যতে সেনাবাহিনীর অফিসারদের বিডিআরে প্রেষণে কাজ করতে নিরুৎসাহিত করা, ৪. বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বিডিআরকে সাংঘর্ষিক অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি করা। ৫. মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৪৮ দিনের নবনির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের প্রয়াসে অস্থিতিশীলতার মধ্যে দেশকে নিপতিত করা, ৬. বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করা এবং ৮. জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বিডিআরের অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকায় দেশের অন্যান্য বাহিনীর অংশগ্রহণ ক্ষতিগ্রস্ত করা ইত্যাদি।