নারী ও শিশু ধর্ষণে চাপ ছাড়া শাস্তির নজির কম

রাজধানীর কোনাপাড়া এলাকায় শিশু নুসরাত ও দোলাকে হত্যাকাণ্ডের এক বছর পার হলেও বিচার পায়নি তারা। হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে নিহত শিশুদের পরিবারের সদস্য ও এলাকাবাসীর মানববন্ধন। গত মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে।  ছবি: প্রথম আলো
রাজধানীর কোনাপাড়া এলাকায় শিশু নুসরাত ও দোলাকে হত্যাকাণ্ডের এক বছর পার হলেও বিচার পায়নি তারা। হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে নিহত শিশুদের পরিবারের সদস্য ও এলাকাবাসীর মানববন্ধন। গত মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে। ছবি: প্রথম আলো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া মজনু ‘সিরিয়াল রেপিস্ট’ বা ‘ক্রমিক ধর্ষক’। গতকাল বুধবার মজনুকে গ্রেপ্তারের পর র‍্যাব সংবাদ সম্মেলন করে এ কথা জানিয়েছে। দ্রুত ধর্ষককে গ্রেপ্তার করায় র‍্যাব সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক থেকে শুরু করে বিভিন্ন মহলে এই আলোচনা শুরু হয়েছে যে সব ধর্ষণের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এমন তৎপরতা দেখায় না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, কুর্মিটোলায় ঘটনা, শিক্ষার্থীদের আলটিমেটাম, আন্দোলন, ছাত্রীর পাশে শিক্ষকদের উপস্থিতি, সমাবেশ-মানববন্ধন—সব মিলে একধরনের চাপ সৃষ্টি হয়। তাই ধর্ষককে গ্রেপ্তারসহ অন্যান্য প্রক্রিয়া বেশ দ্রুত হয়েছে বলে মনে করছেন আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীসহ সংশ্লিষ্টরা।
তবে এই রাজধানীতেই বিপরীত চিত্র দেখা যায়। মাত্র দুই দিন আগে গত মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার দুই শিশুর মায়েরা ন্যায়বিচার চেয়ে মানববন্ধন করেছেন। দিনটি ছিল শিশু দুটির মৃত্যুবার্ষিকী।

রাজধানীর ডেমরায় নুসরাত জাহান (৪) ও ফারিয়া আক্তার দোলাকে (৫) ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে হত্যা করা হয়। শিশু দুটি স্কুল থেকে ফিরে বাসার সামনে খেলছিল। লিপস্টিক দেওয়ার কথা বলে একটি ফ্ল্যাটে নিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা করেছিলেন গোলাম মোস্তফা ও আজিজুল বাওয়ানী নামের দুই যুবক। শ্বাসরোধে শিশু দুটিকে হত্যা করেন তাঁরা।

এই মামলার আইনজীবী মো. এনামুল হক বললেন, ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩) অনুযায়ী বিচারের জন্য মামলাপ্রাপ্তির তারিখ থেকে ১৮০ দিনের মধ্যে ট্রাইব্যুনাল বিচারকাজ সমাপ্ত করবে। কিন্তু এ মামলায় এক বছর হয়ে গেছে।’ তিনি বলেন, আসামি কারাগারে থাকা মানে তো বিচার পাওয়া না।

বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা বললেন, ধর্ষণের শিকার হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বা তাঁর পরিবারের যে কষ্ট, একজন পোশাকশিল্পের শ্রমিক বা নিম্নবিত্ত পরিবারের নারী ও শিশুর বেলায়ও একই কষ্ট। তাই কোনো ঘটনাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া ঠিক না। তিনি বলেন, ‘ধর্ষণের ঘটনায় বিচার চেয়ে আমাদের আন্দোলন করতে হচ্ছে। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ছাত্রী গত রোববার রাতে কুর্মিটোলা এলাকায় ধর্ষণের শিকার হন। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে চিকিৎসাধীন। ক্যান্টনমেন্ট থানায় ছাত্রীর বাবা মামলা করেছেন। আনুষ্ঠানিকভাবে মামলাটির দায়িত্ব ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখাকে (ডিবি) দেওয়া হয়েছে।

>

মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবীদের ধারণা, গণমাধ্যম গুরুত্ব দিলে এবং চাপ থাকলে পুলিশসহ সংশ্লিষ্টরা ঘটনাটি গুরুত্ব দেন

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম বললেন, নারী ও মানবাধিকার সংগঠন সব সময় ধর্ষণের বিরুদ্ধে কথা বলে। এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামায় একটা চাপ তো তৈরি হয়েছে। তবে শুধু বিশেষ একটি–দুটি ঘটনায় নয়, সব ঘটনাতেই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে বলে উল্লেখ করেন ওই নারীনেত্রী।

মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবীদের ধারণা, নারী নির্যাতন বা ধর্ষণের ঘটনার বিষয়টি গণমাধ্যম গুরুত্ব দিলে, সাধারণ মানুষ ও বিভিন্ন মহলের চাপ থাকলে তাতে পুলিশসহ সংশ্লিষ্টরাও গুরুত্ব দেন। টাঙ্গাইলের রুপা বা ফেনীর নুসরাত হত্যাসহ বিভিন্ন ঘটনায় এটা দেখা গেছে।

গত বছরের ২৪ অক্টোবর ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান (রাফি) হত্যা মামলার রায়ে অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলাসহ ১৬ জনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। রায় পড়ার শুরুতেই গণমাধ্যমের ভূমিকার প্রশংসা করেন আদালত। আদালত বলেন, গণমাধ্যমের কারণেই এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা দেশবাসী জানতে পারে। ৬১ কার্যদিবসে এ মামলার কার্যক্রম শেষ হয়।

গত ৬ এপ্রিল মাদ্রাসার প্রশাসনিক ভবনের ছাদে ডেকে নিয়ে নুসরাতের হাত-পা বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। ১০ এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নুসরাতের মৃত্যু হয়।

২০১৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ১৪টি কর্মদিবসের পর টাঙ্গাইলের চাঞ্চল্যকর রুপা খাতুন ধর্ষণ ও হত্যার মামলার রায়ে চারজনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট চলন্ত বাসে ধর্ষণের পর হত্যা করে টাঙ্গাইলের মধুপুর বন এলাকায় ফেলে যাওয়া হয়। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল এ ঘটনা।

রাজধানীতেই ধর্ষণচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হত্যার শিকার হওয়া মাত্র দুই বছরের শিশু আয়েশা মণির মা রাজিয়া সুলতানাও মেয়ের বিচার চেয়ে প্রেসক্লাবের সামনে বসেছিলেন কয়েকবার। গত বছরের ২১ জুলাইও তিনি এভাবে সবার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছিলেন।

গেন্ডারিয়ায় এক বস্তিতে থাকত আয়েশা মণি (২)। গত বছরের ৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় চারতলা একটি ভবনের সামনে আয়েশার রক্তাক্ত নিথর দেহ পড়ে ছিল। বাবা মো. ইদ্রিস বাদী হয়ে গেন্ডারিয়া থানায় মামলা করেন। এ ঘটনায় নাহিদ নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। নাহিদের ১৪ বছর বয়সী মেয়ে সাক্ষী হিসেবে ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দিয়ে বিস্তারিত বলেছে। তবে আসামিপক্ষের হুমকির মুখে পরিবারটি ঢাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে।

মামলার চার্জশিট হয়েছে জানিয়ে আয়েশার মা টেলিফোনে বললেন, ‘আমি প্রেসক্লাবের সামনে বসতাম, তখন কাউরে পাশে পাই নাই। সবাই ভয় পাইছে। মাইয়্যার মৃত্যুবার্ষিকী গেল, আমি তো বিচার পাইলাম না।’