ক্যাসিনো-কাণ্ডে উদ্যোক্তাদের গায়ে আঁচ লাগেনি

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সাড়ে তিন মাস পার হলেও ঢাকার চারটি ক্লাবে ক্যাসিনো ব্যবসার উদ্যোক্তা ও কর্মকর্তা–কর্মচারী হিসেবে কাগজে–কলমে দেশি–বিদেশি যাঁদের নাম আছে, তাঁদের কাউকে আইনের আওতায় আনা হয়নি। আবার এসব ক্লাব থেকে যাঁরা নিয়মিত চাঁদা তুলতেন কিংবা চাঁদার ভাগ পেতেন, তাঁদেরও বিচারের আওতায় আনা হয়নি।

মতিঝিলের মোহামেডান ক্লাব, ভিক্টোরিয়া ও দিলকুশা ক্লাবের নথিপত্রের তথ্য অনুযায়ী, মতিঝিলের মোহামেডান ক্লাব এবং বনানীর গোল্ডেন ঢাকা নামের ক্লাবে দীর্ঘদিন ধরে ক্যাসিনো ব্যবসা চালিয়ে আসছিলেন আবুল কাশেম ও ইমরান আহমেদ নামের দুই ব্যক্তি। দুজনই এখন পলাতক। আর ভিক্টোরিয়া ক্লাবটি পরিচালনা করতেন নেপালি নাগরিক নাগিন। দিলকুশা ক্লাবটির পরিচালনায় যুক্ত ছিলেন রাজকুমার ও রাজিন।

র‍্যাবের সহকারী পরিচালক (গণমাধ্যম) মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মতিঝিলের ক্লাবগুলোয় ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ইতিমধ্যে প্রভাবশালী তিন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জড়িত অন্যদের আইনের আওতায় আনা হবে।

মোহামেডান, ভিক্টোরিয়া ও দিলকুশা ক্লাবের রেজিস্টার ও কাগজপত্রের তথ্য পর্যালোচনা করে দেশি-বিদেশি ৪৪ জনের নাম-পরিচয় জানা গেছে, যাঁরা ক্যাসিনো ব্যবসা পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের একটি অংশ বিদেশি নাগরিক। ইতিমধ্যে তাঁরা পালিয়ে গেছেন।

এর বাইরে মোহামেডান ক্লাবের নথিপত্র থেকে ২৯ জন অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির (ভিভিআইপি) নাম পাওয়া গেছে, যাঁরা ভিআইপি অতিথি হিসেবে ক্লাবগুলোয় নানা সুযোগ-সুবিধা নিতেন এবং নিয়মিত সেখানে ক্যাসিনো খেলতেন। তাঁদের মধ্যে আছেন মিরপুর ও মতিঝিল এলাকার থানা পর্যায়ের দুজন আওয়ামী লীগ নেতা, বিদ্যুৎ বিভাগের প্রকৌশলী, নামকরা দুজন পুস্তক প্রকাশক, সুপরিচিত একজন খল অভিনেতা এবং কয়েকজন তরুণ ব্যবসায়ী। এ ছাড়া মোহামেডান ক্লাবে নিয়মিত ক্যাসিনো খেলতেন, এমন অন্তত ২০০ জনের নাম মোহামেডান ক্লাবের নথিপত্র থেকে জানা গেছে।

>

মোহামেডান ক্লাবে ভিভিআইপি অতিথি ছিলেন ২৯ জন 
নিয়মিত ক্যাসিনো খেলতেন অন্তত ২০০ জন

মোহামেডান ক্লাবের দৈনিক আয়–ব্যয়ের হিসাবপত্রে সালাউদ্দিন নামের এক ব্যক্তির নাম উল্লেখ রয়েছে, যিনি প্রতিদিন মোহামেডান ক্লাব থেকে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা নিয়ে যেতেন। অনুসন্ধানে মোহামেডান ক্লাব থেকে চাঁদা আদায়কারী সেই সালাউদ্দিনের পরিচয় জানা গেছে। মোহামেডান ক্লাবের নিরাপত্তারক্ষী আবুল কাশেম প্রথম আলোকে বলেন, সালাউদ্দিন বহিষ্কৃত কাউন্সিলর যুবলীগ নেতা মমিনুল হক সাঈদের পরিচিত। সাঈদকে তিনি মামা ডাকতেন। মোহামেডান ক্লাবের ভেতরে তাস খেলার বোর্ড চালাতেন সালাউদ্দিন।

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হয় গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর। সেদিন রাজধানীর মতিঝিলের ফকিরেরপুল ইয়ংমেনস ক্লাব, ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, গুলিস্তানের মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব ও বনানীর গোল্ডেন ঢাকা ক্লাবে অভিযান চালায় র‍্যাব। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ক্লাবের ১৮২ জন কর্মকর্তা–কর্মচারীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন র‍্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এরপর ক্যাসিনো ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগে মোহামেডান ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া ও ফকিরেরপুল ইয়ংমেনস ক্লাবের মালিক যুবলীগ নেতা খালেদ হোসেন ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। মামলা করা হয় ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে ক্যাসিনো পরিচালনাকারী সহোদর এনামুল হক ভূঁইয়া ও রুপন ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে। এরপর থেকে দুজনই পলাতক।

মতিঝিল পাড়ার দুটি ক্লাবে র‍্যাবের অভিযানের তিন দিন পর গত ২১ সেপ্টেম্বর মোহামেডান, ভিক্টোরিয়া, দিলকুশা ও আরামবাগ ক্লাবে অভিযান চালায় পুলিশ। সেদিন কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। তবে ক্যাসিনো খেলার বোর্ডসহ বিভিন্ন মালামাল জব্দ করে পুলিশ। এ ঘটনায় মতিঝিল থানায় পুলিশের পক্ষ থেকে শুধু একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়।

মতিঝিল থানার পরিদর্শক মনির হোসেন মোল্লা জানান, চারটি ক্লাবে অভিযান চালিয়ে তাঁদের কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।

ঢাকা মহানগর পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, মোহামেডানসহ চারটি ক্লাবে অভিযানের পর জিডি হয়েছিল। এর তদন্ত চলছে। এসব ক্লাবে ক্যাসিনো ব্যবসায় জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হবে।

ক্লাবের নথিপত্রের তথ্য বলছে, মোহামেডান ক্লাবে ক্যাসিনো ব্যবসা পরিচালনায় ছিলেন আবুল কাশেম ও ইমরান আহমেদ নামের দুই ব্যক্তি। ক্লাবের ক্যাসিনোর সাবেক কর্মচারী আশিক রুশদি ও গান্ধী হাওলাদার বলেন, কাশেম ও ইমরান দুজনই মমিনুল হক ও ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাটের ঘনিষ্ঠ ছিলেন।

ক্যাসিনোর মালিক আবুল কাশেমের গাড়িচালক মো. সুজন প্রথম আলোকে বলেন, ফকিরেরপুলের ইয়ংমেনস ক্লাবে র‍্যাবের অভিযানের পর থেকে তাঁর মালিক কাশেম পলাতক। কাশেমের বাড়ি চাঁদপুরে। তিনি তৈরি পোশাকশিল্প ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন। বনানীর গোল্ডেন ঢাকা ক্লাবে নিয়মিত ক্যাসিনো খেলতেন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সদস্য ইসরাফি আশরাফ। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, তিনি নিজে ক্যাসিনো খেলতেন। মোহামেডান ও গোল্ডেন ঢাকা ক্লাবে ক্যাসিনো চালাতেন কাশেম ও ইমরান।

কাশেমের জাতীয় পরিচয়পত্রে তাঁর বর্তমান ঠিকানা দেওয়া আছে ১২/বি, আলামিন টাওয়ার, শান্তিনগর। সম্প্রতি ওই বাসায় গেলে নিরাপত্তারক্ষী আবদুল মান্নান জানান, কয়েক বছর আগে ওই বাসায় থাকতেন কাশেম।

কাশেমের গাড়িচালক সুজন জানান, ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান চলার পর থেকে আর কাশেমের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নেই। কাশেমের মুঠোফোন বন্ধ রয়েছে।

মোহামেডান ক্লাবের কাগজপত্রের তথ্য অনুযায়ী, মোহামেডান ক্লাব পরিচালনায় যুক্ত থাকা ১৩ নেপালি নাগরিক হলেন পঞ্চ কুমার শ্রেষ্ঠ, সুরেশ শ্রেষ্ঠ, সানু বাবু শাহি, রাধাকৃষ্ণ শ্রেষ্ঠ, বিকাশ, বচন রণজিৎ, ইন্দা লামিচান্স, পদাম সাউদ, সুরাজ নাগরতি, বিক্রম, প্রভিন ও নিরোজ।

 মোহামেডান ক্লাবের সাবেক দুই কর্মচারী প্রথম আলোকে বলেন, যুবলীগ নেতা সম্রাট একসময় নিয়মিত বসতেন ভিক্টোরিয়া ক্লাবে। এই ক্লাবের ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে সম্রাট জড়িত ছিলেন। ভিক্টোরিয়া ক্লাবের কাগজপত্রের তথ্য বলছে, নেপালি নাগরিক নাগিন এখানে ক্যাসিনো ব্যবসা পরিচালনার অন্যতম ব্যক্তি। তাঁর নেতৃত্বে নেপালি নাগরিকেরা এই ক্লাবে ক্যাসিনো ব্যবসা চালাতেন।

ভিক্টোরিয়া ক্লাবের নথিপত্রের তথ্য বলছে, নেপালি নাগরিক নাগিনের নেতৃত্বে ক্যাসিনো ব্যবসা পরিচালনায় যুক্ত ছিলেন নেপালি ১২ নাগরিক। তাঁরা হলেন হেমন্ত শাহ, অনিল কারকি, সন্তোষ অধিকারী, পুষ্প পান্থ, ডিরাব উপেথি, কে পে আচার্য, ভুবন বোস, বিনোদ, মনোজ, নগেন্দ্র, রণজিৎ ও মিলন। এর বাইরে ভিক্টোরিয়া ক্লাবের রেজিস্টার থেকে আরও অন্তত ৭০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম জানা গেছে।

দিলকুশা ক্লাব রেজিস্টারের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেল, ক্লাবটিতে নেপালি নাগরিক রাজকুমার ও রাজিনের নেতৃত্বে ১৬ জন নেপালি ক্যাসিনো ব্যবসা পরিচালনায় যুক্ত ছিলেন। এই দুজন ছাড়া অপর ১৪ নেপালি নাগরিক হলেন রমেশ, বিনোদ, রাজেশ, সঞ্জীব, জীবেন, শ্যাম, সুশীল, উমেশ, রমেশ, অশোক, চাঁদ, রোশান, দিনেশ ও রমেন।

ক্যাসিনো ব্যবসা পরিচালনায় যুক্ত নেপালি অনেক নাগরিককে বিদেশে পালিয়ে যেতে সহায়তা করার অভিযোগ রয়েছে পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে।

গত বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় নেপালিদের পালিয়ে যেতে সহায়তা করায় দুই পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, অসাধু পুলিশ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে মতিঝিল থানার আশপাশের ক্লাবগুলোয় দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা পরিচালিত হয়েছে। কান টানলে মাথা আসবে—এমন পরিস্থিতি বিবেচনা করে হয়তো অভিযান স্তিমিত হয়েছে। ক্লাবগুলোর কাগজপত্রে যাঁদের নাম আছে, যাঁরা ক্যাসিনোর উদ্যোক্তা, কর্মকর্তা–কর্মচারী এবং যাঁরা বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে অবশ্যই মামলা হওয়া উচিত।


● আগামী পর্ব: ৩৫ জনের বিদেশ যেতে মানা