মোহন সরকারের সুরের জাদু

জন্মান্ধ স্বভাবশিল্পী মোহন সরকার। বয়স ষাট ছুঁই–ছুঁই। জীবন দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত। পথের ধারে, বাসে, হাটবাজারে গান গেয়ে সংসার চালান কোনোমতে। কিন্তু তাঁর সুরের জাদুতে মুগ্ধ হন না, এমন মানুষ পাওয়া ভার। বিশেষ করে তাঁর বাঁশির জাদুতে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যান পথচারী, হাটুরে থেকে শুরু করে বাসের যাত্রীরা।

মোহন সরকারের গ্রামের বাড়ি শেরপুর সদরের নন্দির বাজার এলাকায়। জন্ম থেকেই দুই চোখে দেখতে পান না তিনি। প্রথমে তিনি ওই এলাকায় বাসে ও বাজারে ঘুরে ঘুরে গান শোনাতেন। পরে তিনি ছেলের লেখাপড়ার কারণে চলে আসেন গাজীপুরে। বর্তমানে তিনি গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার মৌচাক স্কাউট প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পাশে আয়েশ মার্কেট এলাকায় একটি বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন। গাজীপুর, চান্দনা চৌরাস্তা, মৌচাক, সফিপুর, কালিয়াকৈরসহ আশপাশের এলাকায় গান করে দিন পার করেন তিনি।

গত সোমবার দুপুরে কালিয়াকৈর উপজেলার সফিপুর বাজারে কথা হয় মোহন সরকারের সঙ্গে। এ সময় তাঁর গান শুনে বেশ কিছু লোক জড়ো হন সেখানে। উপস্থিত শ্রোতা-দর্শকেরা গান শুনতে চাইলে তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘কী গান শুনতে চান?’ উপস্থিত মানুষজন বলেন, ‘শোনান আপনার পছন্দমতোই কোনো গান।’ সঙ্গে সঙ্গে দোতারা হাতে তুলে নিয়ে গাইতে শুরু করেন মোহন সরকার, ‘সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন। সত্য সুপথ না চিনিলে পাবিনে মানুষের দরশন, ওরে আমার মন।’

দোতারা বাজিয়ে গান গাইছেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মোহন সরকার। এই তিনিই যখন দোতারা রেখে বাঁশি হাতে তুলে নেন, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যান শ্রোতা-দর্শকেরা। গত সোমবার দুপুরে কালিয়াকৈর উপজেলার সফিপুর বাজারে।  ছবি: প্রথম আলো
দোতারা বাজিয়ে গান গাইছেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মোহন সরকার। এই তিনিই যখন দোতারা রেখে বাঁশি হাতে তুলে নেন, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যান শ্রোতা-দর্শকেরা। গত সোমবার দুপুরে কালিয়াকৈর উপজেলার সফিপুর বাজারে। ছবি: প্রথম আলো

একপর্যায়ে দোতারা রেখে হাতে তুলে নেন বাঁশের বাঁশি। বাঁশির সুরে তাঁর এমনই জাদু, যে দর্শকেরা কিছুক্ষণের জন্য ডুবে যান সেই আবেশে। বাঁশিতে যেকোনো গানেরই সুর তুলতে পারেন মোহন সরকার।

মোহন সরকারের এক মেয়ে, দুই ছেলে। মেয়ে দিলরুবা আক্তার (২১) বছর দেড়েক আগে চট্টগ্রাম মহিলা পলিটেকনিক থেকে ইলেকট্রনিকসে ডিপ্লোমা শেষ করেছেন। এখন কাজের সন্ধানে আছেন। মোহন জানান, মেয়ে চট্টগ্রাম রেলওয়েতে ইন্টার্নশিপ করেছেন। এরপরও চাকরি পাচ্ছেন না। টাকার অভাবে মেয়েকে বিএসসিতে ভর্তি করাতে পারেননি বলেও জানান। ছোট ছেলে ধ্রুব সরকার (১৭) কালিয়াকৈর উপজেলার মৌচাক স্কাউট উচ্চবিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে। বড় ছেলে রতন সরকার (২৫) টাইলস মিস্ত্রির কাজ করেন।

মোহন সরকার বলেন, ‘তিনটা ছেলেমেয়ের মধ্যে একটারও যদি চাকরি হইতো, তাইলে ভালোভাবে থাকতে পারতাম। মেয়েডা চাকরির জন্য কত জায়গায় আবেদন করছে, কিন্তু কেউ চাকরি দেয় না। পরিবারটা নিয়া আমি পড়ছি বিপদে।’

কথা বলতে বলতে জানা হয় মোহনের অভাবে-কষ্টে ছেলেবেলার বেড়ে ওঠার গল্পও। সেই ছোট বয়সে মোহনকে রেখে মারা যান তাঁর মা। ঘরে সৎমা আসার পর মোহনের জীবনটাই পাল্টে যায়। একে চোখে দেখেন না, তার ওপর সৎমায়ের অত্যাচার। বড় ভাই, ছোট ভাইয়েরা ধরেও মারধর করত। সারা দিন সংসারের কাজ করাতেন সৎমা। গরু–ছাগল দেখা থেকে শুরু করে বাড়ির কাজের লোকদের দেখভালও করতে হতো তাঁকে। তবে তাঁর গানের নেশা ছিল ছোটবেলা থেকেই। একটু অবসর পেলেই গ্রামের চাঁন মিয়ার কাছে গিয়ে বাঁশি বাজানো শিখতেন। স্কুলের মাঠে বসে গান গাইলে বা বাঁশি বাজালে ছাত্ররা টিফিন খাওয়াত। শিক্ষকেরা আদর করতেন। মোহন তখন থেকেই বুঝতে পারেন, গানের সম্মান আছে।

মোহন সরকার বলেন, ‘ছোটবেলা থাইক্যাই দুঃখকষ্টে মানুষ হইছি। কোনো সুখের মুখ দেখতে পারমু কি না জানি না। আমার দিনে কখনো ২০০, কখনো ৫০০ টাকা আয় হয়। আয়ডাও হয় গান গাইয়া। মানুষ গান শুইন্যা যা দেয়, তাই দিয়াই সংসারডা কোনো রহমে চলতাছে। আপনারা যদি আমার ছেলেমেয়েদের একটা চাকরি দিয়া গতি কইরা দিতে পারতেন, তাইলে খুবই উপকার হইতো। ছেলেডার স্কুলের খরচ, বাড়িভাড়া দিয়ে কোনো রহমে খাইয়া না–খাইয়া বাঁইচা আছি। মেয়েডাও বড় হইছে। বিয়া দেওয়াও দরকার।’