ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন: ইসির বক্তব্য আমলে নিচ্ছে না আ.লীগ

>ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন। আ. লীগ মনে করে, সব নির্বাচনেই সাংসদেরা আড়ালে থেকে কাজ করেন। এটা অনেকটাই দলীয় কর্মকাণ্ডের আওতায় পড়ে।

দুই জ্যেষ্ঠ নেতা ও সাংসদের ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালনের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের (​ইসি) বক্তব্য আমলে নিচ্ছে না আওয়ামী লীগ। দলটি মনে করছে, সাংসদদের ভোট চাওয়ার বিষয়ে বিধিনিষেধ আছে। কিন্তু দলের অবস্থান তুলে ধরা, দলীয় প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী কৌশল প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নে বাধা থাকার কথা নয়। অতীতেও সাংসদেরা স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে এমনটা করেছেন। এবার অনেকটা আড়ালে থেকেই তাঁরা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। 

যদিও ইসি বলেছে, কোনো সাংসদ সিটি নির্বাচনে কোনো প্রার্থীর সমন্বয়ক হতে বা ঘরোয়াভাবেও কারও পক্ষে কাজ করতে পারবেন না।

৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি ও উপদেষ্টা পরিষদের যৌথ সভায় ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচন সমন্বয়ের জন্য দুটি কমিটি করার সিদ্ধান্ত হয়। দক্ষিণ সিটির দায়িত্ব দেওয়া হয় দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাংসদ আমির হোসেন আমুকে। আর উত্তরের দায়িত্ব পান উপদেষ্টা পরিষদের আরেক সদস্য ও সাংসদ তোফায়েল আহমেদ। এই দুই সমন্বয় কমিটির সদস্যসচিব করা হয়েছে আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগরের দুই কমিটির দুই সাধারণ সম্পাদককে। এ ছাড়া আরও বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা ও সাংসদকে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই দুই কমিটি ঘোষণা করা হয়নি। তবে কমিটির সদস্যরা প্রায় প্রতিদিনই দুই সিটির নির্বাচনসংক্রান্ত নানা কৌশল নিয়ে বৈঠক করছেন।

গত শনিবার তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে উত্তরের সমন্বয় কমিটির নেতারা প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা ও অন্য কমিশনারদের সঙ্গে নির্বাচন ভবনে গিয়ে বৈঠক করেন। পরে কমিশনের পক্ষে সিইসি নূরুল হুদা এবং আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলের পক্ষে তোফায়েল আহমেদ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। সিইসি বলেন, সাংসদেরা ঘরোয়াভাবে বা বাইরে নির্বাচনসংক্রান্ত কোনো সমন্বয়ের কাজ করতে পারবেন না। অন্যদিকে তোফায়েল আহমেদ বলেন, ভোট চাওয়া ও প্রচার চালানো ছাড়া সাংসদেরা সবই করতে পারেন। 

সিইসি ও আওয়ামী লীগের বিপরীতমুখী অবস্থানের পরই দুই মহানগর সমন্বয় কমিটির নেতৃত্বে থাকা দুই সাংসদের দায়িত্ব পালন করা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়।

সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আচরণবিধি অনুযায়ী, সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা নির্বাচনের প্রচার বা নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবেন না। অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির তালিকায় আছেন প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, মন্ত্রী, চিফ হুইপ, ডেপুটি স্পিকার, সংসদ উপনেতা, বিরোধীদলীয় নেতা, বিরোধীদলীয় উপনেতা, প্রতিমন্ত্রী, হুইপ, উপমন্ত্রী বা সমমর্যাদার পদে থাকা ব্যক্তি, সংসদ সদস্য এবং সিটি করপোরেশনের মেয়র। তবে তাঁরা সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটার হলে ভোট দিতে পারবেন। ইসি সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকার আমলেই বিধিমালায় এই বিধান যুক্ত করা হয়। পরবর্তী সময়ে কাজী রকিবউদ্দীন কমিশনের সময়ে এই বিধি পরিবর্তনের উদ্যোগ নিলেও তা শেষ পর্যন্ত হয়নি। বর্তমান কমিশনের সময়েও ২০১৮ সালের চার সিটি নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ এই বিধি পাল্টানোর দাবি তুলেছিল।

নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কারা, তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। কারণ, আচরণবিধিতে সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সংজ্ঞায়িত করা আছে। আর বিধিমালায় বলা আছে, সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা নির্বাচনী এলাকায় প্রচারণা এবং নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক সূত্র বলছে, নির্বাচন কমিশন যা-ই বলুক, প্রচারে অংশ নেওয়া ছাড়া দলের সাংসদেরা সবই করবেন। সমন্বয় কমিটির বাইরেও মন্ত্রী, সাংসদ ও সাবেক আমলারা দলীয় কার্যালয়ে কিংবা বাসায় বসে নির্বাচনের নানা কৌশল ঠিক করছেন। এমনকি প্রশাসনিক নানা বিষয় দেখাশোনার জন্যও মন্ত্রী-সাংসদেরা তৎপর আছেন। 

তবে গতকাল আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর সভা শেষে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন যে কথা বলেছে, সে বিষয়ে আমরা দ্বিমত পোষণ করি না। এখানে আমাদের আরও রাজনৈতিক কার্যাবলি আছে, সিটিতে আরও কাজ আছে, সেটা তাঁরা করবেন। তাঁরা প্রচারে অংশ নেবেন না। নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন হবে তেমন কোনো কাজে তাঁরা অংশ নেবেন না।’

দলীয় সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে সমন্বয় কমিটি ঘোষণা করেনি। ফলে আমির হোসেন ও তোফায়েল আহমেদ অনেকটা দলীয় কর্মসূচিই পালন করছেন বলে ধরে নেওয়া যায়। গতকাল রোববার জাতীয় প্রেসক্লাবে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তোফায়েল আহমেদ বলেন, সিটি করপোরেশনের আচরণবিধিতে সমন্বয়ক বলে কোনো শব্দ নেই। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সাংসদেরা উপস্থিত থেকে বক্তব্য দিতে পারবেন, কিন্তু ভোট চাইতে পারবেন না। এ ছাড়া বাকিরা ভোট চাইতে পারবেন। এতে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন হবে না। নির্বাচন কমিশনও এ বিষয়ে তাঁদের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে। 

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে সিটি নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। দলের নেতা-সাংসদেরা তো নির্বাচন উপলক্ষে দলীয় কর্মকাণ্ড পালন করতেই পারেন। কেউ তো মিছিল কিংবা মাঠে গিয়ে ভোট চাইছেন না। 

এ বিষয়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী বেসরকারি সংস্থা ব্রতীর নির্বাহী পরিচালক শারমিন মুরশিদ প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনটা হচ্ছে দলীয় ভিত্তিতে। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ নানা ব্যবস্থাপনা থাকে। এ জন্য চাইলে যে কেউ যেকোনো যুক্তি উপস্থাপন করতে পারেন। তবে আচরণবিধি অনুসারে, এটা স্পষ্ট যে মন্ত্রী-সাংসদেরা কোনো রকম নির্বাচনী কর্মকাণ্ড বা প্রচারে অংশ নিতে পারেন না। এটা করলে আচরণবিধির লঙ্ঘন হবে।