৫ বছর ধরে রোহিঙ্গাদের ভোটার বানাচ্ছে চক্র

পাঁচ বছর ধরেই টাকার বিনিময়ে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের ভোটার বানাচ্ছিল একটি চক্র। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে কাজটি করে আসছিল কর্মচারীদের একটি চক্র। এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৩ হাজার ৮০০ রোহিঙ্গার নামে বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দেওয়া হয়েছে।

চট্টগ্রামে এ-সংক্রান্ত মামলার তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র এবং ইসির পাঁচ কর্মচারীর আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এসব জবানবন্দিতে জালিয়াতির ঘটনায় যুক্ত হিসেবে ইসির জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন ও সেবা বিভাগের দুজন কর্মকর্তাসহ মোট ৩৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম এসেছে। 

এনআইডি জালিয়াতি মামলার তদন্তকারী সংস্থা চট্টগ্রাম পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের উপকমিশনার হাসান মোহাম্মদ শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৪ সাল থেকে এনআইডি জালিয়াতি করে আসছে চট্টগ্রামকেন্দ্রিক চক্রটি। কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণে চক্রটি ইসির সার্ভার নিয়ে নয়ছয় করতে পেরেছে।

এনআইডি জালিয়াতির মামলায় এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন ১৫ জন। তাঁদের মধ্যে ১১ জন ইসির কর্মী। যাঁদের চারজন স্থায়ী ও সাতজন অস্থায়ী কর্মচারী। বাকিরা তাঁদের সহযোগী। পাঁচজন আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। তাঁরা হলেন ইসির চট্টগ্রাম কার্যালয়ের অফিস সহায়ক নাজিম উদ্দিন, অফিস সহায়ক আনোয়ার হোসেন, জয়নাল আবেদীন, অস্থায়ী ডেটা এন্ট্রি অপারেটর মোস্তফা ফারুক ও ইসি ঢাকা কার্যালয়ের অস্থায়ী কর্মচারী শাহনুর মিয়া। তাঁদের জবানবন্দিতে ইসির ল্যাপটপসহ অন্যান্য সরঞ্জাম বাসায় নিয়ে রোহিঙ্গাদের ভোটার করা এবং কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তা ইসির সার্ভারে আপলোড করার বর্ণনা উঠে আসে।

গত বছরের ২২ আগস্ট লাকী নামের এক নারী চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে এনআইডির স্মার্ট কার্ড তুলতে গেলে কর্মকর্তাদের সন্দেহ হয়। পরে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে ওই নারী রোহিঙ্গা এবং টাকা দিয়ে এনআইডি করিয়েছেন। বিষয়টি তখন প্রথম আলো প্রতিবেদন করে। ওই ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় ও পরে ডবলমুরিং থানায় ইসি মামলা করে। প্রথম মামলাটি সিআইডি আর দ্বিতীয় মামলাটি পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট তদন্ত করছে। সর্বশেষ ১১ ডিসেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অর্থ পাচার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ইসির কর্মচারী জয়নালসহ আটজনের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা করে।

>

পাঁচ বছরে ভোটার হয়েছে কমপক্ষে ৩৮০০ রোহিঙ্গা
এক কর্মচারী একাই ভোটার করেন ১৮৪০ জনকে
রোহিঙ্গাদের ভোটার করা ইসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের খোঁজে দুদক
আটজনের ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেন

দুদক চট্টগ্রামের পরিচালক মাহমুদ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের ভোটার করতেন ইসির কিছু কর্মচারী। ব্যাংকে আটজনের ৬৭ লাখ টাকা লেনদেনের তথ্য পেয়ে মামলা করে দুদক। তাদের সহায়তাকারী কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অবৈধ সম্পদের খোঁজ নিচ্ছে দুদক। ইতিমধ্যে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাসহ পাঁচজনকে তলব করা হয়েছে।

২০১৫ থেকে সক্রিয় জালিয়াত চক্র

আদালত ও তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আদালতে ইসির পাঁচ কর্মীর দেওয়া জবানবন্দিতে যাঁদের নাম এসেছে, সেখানে ছয়-সাতজন কর্মকর্তা, বাকিরা কর্মচারী।

জবানবন্দিতে ইসির ডেটা এন্ট্রি অপারেটর মোস্তফা ফারুক বলেন, নির্বাচন কমিশনের সরকারি ল্যাপটপ, ফিঙ্গার মেশিন, ক্যামেরা, সিগনেচার প্যাড ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি কর্মচারীরা ছুটির দিনে বাসায় নিয়ে যেতেন। ভোটার করতেন দালালের মাধ্যমে আসা রোহিঙ্গাদের। 

মোস্তফা ফারুক বলেন, তিনি ২০১৫ সালে প্রথম ইসির ঢাকার কর্মচারী শাহনুরের বাসায় ইসি কার্যালয়ের ১০ থেকে ১২টি ল্যাপটপ দেখতে পান। এসব বাসায় কেন জিজ্ঞেস করলে শাহনুর বলেন, এটা তাঁর জন্য কোনো ব্যাপার না।

শাহনুর মিয়া জবানবন্দিতে বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গত বছরের সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রামের কিছু রোহিঙ্গা ও অবৈধ ভোটারকে তালিকাভুক্ত করার জন্য তাঁকে (শাহনুর) বলেন। এরপর তিনি চট্টগ্রাম নির্বাচন কার্যালয়ের অপারেটর মো. শাহীনের মাধ্যমে আট থেকে দশজনের নাম ভোটার তালিকায় তুলে দেন। তাঁদের ছবি তোলা হয় চট্টগ্রাম নির্বাচন কার্যালয়ে। এই কাজের জন্য ওই কর্মকর্তা শাহনুরকে ৫০ হাজার টাকা নেন। শাহনুর সেখান থেকে ২০-২৫ হাজার টাকা শাহীনকে দিয়েছিলেন।

জবানবন্দিতে শাহনুর বলেন, ঢাকার ওই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ ধররের কাজ সব সময় চট্টগ্রাম কার্যালয়ের কর্মচারী জয়নাল ও ফারুককে দিয়ে করাতেন। অনিয়মের জন্য ফারুকের কয়েকবার চাকরিও চলে যায়। কিন্তু ওই কর্মকর্তার কারণে আবার চাকরি ফিরিয়ে পান। 

অবশ্য ওই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তিনি রোহিঙ্গাদের ভোটার করাসহ যাবতীয় অনিয়মের বিরুদ্ধে সব সময় কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর বিরুদ্ধে জবানবন্দিতে যা এসেছে সব মিথ্যা।

ইসির উপপরিচালক পর্যায়ের এক কর্মকর্তাকে জড়িয়ে আদালতে জবানবন্দি দেন আসামি মোস্তফা ফারুক। তিনি বলেন, পাঁচলাইশ থানার সাবেক নির্বাচন কর্মকর্তা আবদুল লতিফ শেখ ও অফিস সহায়ক নাজিম উদ্দিন রোহিঙ্গাদের ভোটার করার কাজে যুক্ত ছিলেন। আর আবদুল লতিফ শেখের সঙ্গে ইসির ঢাকা অফিসের এক উপ​পরিচালকের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। 

এ বিষয়ে একাধিকবার চেষ্টা করেও ওই উপপরিচালকের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ই-মেইলে প্রশ্ন পাঠিয়েও তাঁর সাড়া পাওয়া যায়নি। 

অফিস সহায়ক নাজিম উদ্দিন এখন কারাগারে। তিনি আদালতে যে জবানবন্দি দিয়েছেন, তাতে আবদুল লতিফ শেখের জড়িত থাকার কথা বলেছেন। নাজিমের ভাষ্য, মোস্তফা ফারুক ও জয়নাল অবৈধভাবে অফিস সহায়ক হোসেন পাটোয়ারী ও তৎকালীন পাঁচলাইশ নির্বাচন কর্মকর্তা আবদুল লতিফ শেখের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় নিবন্ধনের কাজ করতেন। এর প্রতিবাদ করায় তাঁকে (নাজিম) বান্দরবানে বদলি করা হয়।

তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেন আবদুল লতিফ শেখ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অনিয়মের কারণে কিছু কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। সেই ক্ষোভ থেকে তাঁর নামে মিথ্যা জবানবন্দি দেওয়া হয়েছে। 

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাউন্টার টেররিজম ইউনিট চট্টগ্রামের পরিদর্শক রাজেশ বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, গ্রেপ্তার আসামিদের জবানবন্দিতে ৩০-৩৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম এসেছে। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হওয়ায় যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের জন্য অনুমতি চাওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তদন্ত কার্যক্রমও চলছে।

সাপ্তাহিক বন্ধের দিনে
ইসির কর্মচারী আনোয়ার হোসেনের দেওয়া জবানবন্দিতে রয়েছে, দালাল মো. সেলিম সাপ্তাহিক বন্ধের দিন রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসতেন। অফিস সহায়ক আবুল খায়ের ও ডেটা এন্ট্রি অপারেটর মোস্তফা ফারুক মিলে চট্টগ্রাম শহরের লাভলেইন এলাকায় খায়েরের ভাড়া বাসায় রোহিঙ্গাদের ভোটার করার কাজ করতেন। নির্বাচন কমিশনের সরকারি ল্যাপটপ এবং অন্যান্য ডিভাইস মোস্তফা ও খায়ের সবার অগোচরে বাসায় নিয়ে যেতেন। ভোটার নিবন্ধনের ফরমগুলো সংগ্রহ করতেন মোস্তফা।

মোস্তফা ফারুকও তাঁর জবানবন্দিতে বলেন, আবুল খায়েরের বাসায় শুক্র, শনিবার এনআইডির কাজ করা হতো। তিনিও ইসির ল্যাপটপ, ফিঙ্গার মেশিন, ক্যামেরা, সিগনেচার প্যাড বাসায় নিয়ে যেতেন।

চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানা নির্বাচন কার্যালয়ের সাবেক কর্মচারী জয়নাল আবেদীন নিজেই ১ হাজার ৮৪০ রোহিঙ্গাকে এনআইডি করিয়ে দেওয়ার কথা আদালতে জবানবন্দিতে জানিয়েছেন। জয়নাল বলেন, মোস্তফা ফারুকের মাধ্যমে ৩০০ জন, ইসির ঢাকার কর্মচারী সত্যসুন্দরের মাধ্যমে দেড় হাজার রোহিঙ্গাকে ভোটার করান তিনি। এ ছাড়া নাজিমের মাধ্যমে করিয়েছেন ৪০ জনকে। দালাল নাজিবুল্লাহ ও নুরুল আবছার রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসতেন। জনপ্রতি ভোটার করার জন্য ৫ হাজার টাকা করে পেতেন জয়নাল।

নজরদারিতে ২০ কর্মচারী
এনআইডি জালিয়াতিতে জড়িত থাকার ঘটনায় আরও ২০ কর্মচারীর নাম এসেছে, যাঁদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে বলে তদন্ত-সং​শ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। গ্রেপ্তার হওয়া ইসির অফিস সহায়ক আনোয়ার হোসেন জবানবন্দিতে বলেন, বোয়ালখালী নির্বাচন কার্যালয়ের অফিস সহায়ক আমিন উল্লাহ, বান্দরবান আলীকদমের হামিদ উল্লাহ, কক্সবাজার সদরের মো. মোজাফফর রোহিঙ্গাদের ভোটার করার কাজে জড়িত। এ ছাড়া কক্সবাজারের রামু উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. মাহফুজ, হাটহাজারী নির্বাচন কার্যালয়ের ডেটা এন্ট্রি অপারেটর সাইফুদ্দীন, চট্টগ্রাম কার্যালয়ের অফিস সহকারী ইউসুফ খান, নাসরিন সুলতানা, মো. শাহীন, হোসেন পাটোয়ারি ও কর্মকর্তার গাড়িচালক মিলনসহ ২০ জনের নাম এসেছে। তাঁদের কয়েকজনের সঙ্গে এই প্রতিবেদক যোগাযোগ করেছেন। তাঁরা জালিয়াতিতে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন।

তদন্তকারী সংস্থার কর্মকর্তারা জানান, এনআইডি করার জন্য রোহিঙ্গারা মূলত কক্সবাজার, রাঙামাটি ও বান্দরবান জেলাকে বেছে নিয়েছেন। এই তিন জেলায় স্থানীয় ভোটার তুলনামূলক কম এবং ভাষা প্রায় একই হওয়ায় রোহিঙ্গারা এখান থেকে ভুয়া নাম-ঠিকানা দিয়ে ভোটার তালিকায় নাম ওঠাতে দালাল ধরে থাকেন। আবার এই তিন জেলায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের অনেকে চট্টগ্রাম শহরের ঠিকানা ব্যবহার করে ভোটার হচ্ছেন।

 ইসির ভাষ্য
জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এনআইডি জালিয়াতির ঘটনাটি ধরা পড়ার পর থেকে তাঁরা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছেন। অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তিনি বলেন, জবানবন্দিতে আসা নামগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। নিরীহ কেউ যাতে হয়রানির শিকার না হন, তা-ও দেখা হচ্ছে।

পাঁচ বছর ধরে জালিয়াতি চলছে, আরও আগে কেন সুরক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া হলো না—এ প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম বলেন, যখনই জানা গেছে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ইসির ল্যাপটপের পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করে আরও সুরক্ষিত করা হয়েছে।

তবে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মনে হয় এসব ক্ষেত্রে ইসির নজরদারি ঠিকমতো হচ্ছে না। যারা দায়িত্বে আছেন তারা সেটা করতে পারছেনও না। এভাবে চলতে থাকলে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে।’ তিনি বলেন, দরকার হলে ওই এলাকার ইসির সার্ভার সার্বক্ষণিক চালু না রেখে বন্ধ রাখা হোক, যখন দরকার কেবল তখনই চালু করা হবে।