যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেন, তাঁদের অবস্থান নিরাপদ নয়: আনিসুজ্জামান

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলীকে সপরিবারে হত্যাচেষ্টার প্রতিবাদে আয়োজিত সমাবেশে বক্তব্য দেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। শাহবাগ, সোমবার। ছবি: আশরাফুল আলম
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলীকে সপরিবারে হত্যাচেষ্টার প্রতিবাদে আয়োজিত সমাবেশে বক্তব্য দেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। শাহবাগ, সোমবার। ছবি: আশরাফুল আলম

জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেছেন, ‘আজকে মনে হয়, বাংলাদেশে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করতে বলেন, তাঁদের অবস্থা সব সময় নিরাপদ নয়। বরং মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি অনেক ক্ষেত্রে বেশি শক্তি সঞ্চয় করছে। এটি আমাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একটি ব্যর্থতা।’

রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে আজ সোমবার বিকেলে এক প্রতিবাদী নাগরিক সমাবেশে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এসব কথা বলেন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলীকে সপরিবারে হত্যাচেষ্টার প্রতিবাদে এই সমাবেশের আয়োজন করে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন।

সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ড. সারওয়ার আলীর ওপর যে আক্রমণ হয়েছে, আক্রমণকারীরা যেসব জিনিস ফেলে গেছে, তা থেকে আমাদের মনে দৃঢ় ধারণা হয়, জঙ্গিরা যেভাবে মুক্তবুদ্ধির মানুষকে হত্যা করেছে, এটাও সে রকম। এর তদন্ত হচ্ছে। এই হত্যাচেষ্টার পেছনে ব্যক্তিগত আক্রোশ আছে—এটি আমাদের ভুল পথে নিতে পারে। আমাদের দাবি, তাঁকে হত্যার পেছনে জঙ্গিদের কোনো সংশ্লিষ্টতা আছে কি না, পুলিশ সেটি খতিয়ে দেখবে এবং ব্যবস্থা নেবে।’

ড. সারওয়ার আলীকে হত্যাচেষ্টায় নিন্দা জানিয়ে এই অধ্যাপকের দাবি, এ ঘটনায় জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার দিকটা যেন উপেক্ষা না হয়।

৫ জানুয়ারি রাতে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলীর বাড়িতে ঢুকে তাঁকে ছুরিকাঘাত করে হত্যার চেষ্টা চালায় দুর্বৃত্তরা। তাঁর উত্তরার বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে। সারওয়ার আলী ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি ও চিকিৎসক। তাঁর ধারণা, জঙ্গিগোষ্ঠী এই কাজ করেছে।

আজকের সমাবেশে ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, ‘জাতির অন্যতম বিবেক সারওয়ার আলীকে হত্যাচেষ্টার আট দিন পেরোলেও রাষ্ট্র এ নিয়ে বিচলিত নয়। একদম পরিচিত কায়দায়, পদ্ধতিতে সারওয়ার আলীর ওপর আক্রমণ চালানো হয়েছে।’

পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের নির্মাতারা আক্রান্ত হবে আর এই দেশে মৌখিক মুক্তিযুদ্ধের চর্চা হবে, এই বৈপরীত্য নিয়ে বাংলাদেশ চলতে পারে না। সারওয়ার আলীর ওপর যদি এই আক্রমণ হতে পারে, তাহলে দেশের অন্য নাগরিকদের ওপর কী হতে পারে। এর ব্যাপারে রাষ্ট্রে কি বোধোদয় হলো না। আমরা চিন্তিত, উদ্বিগ্ন, বিচলিত, স্তম্ভিত, ক্ষুব্ধ।’

সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সভাপতি জিয়াউদ্দিন তারিক আলী বলেন, ‘আমরা চাই, সরকার সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা দিক, তারা কি ধর্মান্ধ বাংলাদেশ, নাকি লোকজ-সংস্কৃতিতে ধন্য বাঙালির অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ দেখতে চান? অবিলম্বের সকল ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করতে হবে, এদের রাজনীতিতে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকুক। যদি এই সরকার দেশকে ভবিষ্যতে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়, তাহলে এই মূলনীতিতে অবস্থান পরিষ্কারভাবে জনগণকে জানাতে হবে।’ তাঁর আশা, দুষ্কৃতকারীদের খুব শিগগির ধরা হবে।

সমাবেশে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের পক্ষ থেকে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ। তিনি বলেন, সারওয়ার আলী ও তাঁর পরিবারে ওপর হামলা বিচ্ছিন্ন কোনো আক্রমণ নয়। সারওয়ার আলী নিজেই বলেছেন, ঘটনার সময় যে আলামত পুলিশ পেয়েছে, যেমন পাঁচটি চাপাতি, ভিডিও সরঞ্জাম, ইত্যাদি থেকে বোঝা যায়, এটা সাধারণ হত্যাচেষ্টা ছিল না। এটি ছিল দলীয় সুপরিকল্পিত হত্যাচেষ্টা। এম এম আকাশ বলেন, ‘আমরাও তাঁর সঙ্গে একমত যে এই হত্যাচেষ্টার সঙ্গে অতীতে ধর্মীয় জঙ্গি–সন্ত্রাসীদের দ্বারা নিহত হুমায়ুন আজাদ ও অভিজিৎ রায়ের নিষ্ঠুর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের কিছু কিছু সাদৃশ্য রয়েছে।’

ডা. সারওয়ার আলীকে সপরিবারে হত্যাচেষ্টার প্রতিবাদে আয়োজিত সমাবেশে বক্তব্য দেন ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য। ছবি: আশরাফুল আলম
ডা. সারওয়ার আলীকে সপরিবারে হত্যাচেষ্টার প্রতিবাদে আয়োজিত সমাবেশে বক্তব্য দেন ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য। ছবি: আশরাফুল আলম

মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেন, ‘বর্তমান রাজনৈতিক একটি চর্চা তৈরি হয়েছে, দেশে যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি তাদের বিরুদ্ধে সেই চর্চা চলে গেছে। যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে, স্বাধীনতা অর্জন করেছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা সব সময় বলে, সেই মানুষগুলোই বলছে, আমরা সংখ্যায় কমে গেছি। আমরা সংখ্যালঘু হচ্ছি। এর থেকে দুঃখের বিষয় আর হতে পারে না। যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে, তাদের ওপরই ধারাবাহিকভাবে আক্রমণ হচ্ছে এবং এর কোনো প্রতিকার হচ্ছে না।’

সমাবেশ থেকে দুটি দাবি জানানো হয়—এক, বিশেষ গোয়েন্দা বাহিনী নিয়োগ করে সারওয়ার আলী হত্যাচেষ্টায় জড়িত হুকুমদাতা ও হুকুম পালনকারীদের গ্রেপ্তার, বিচার ও কঠোর শাস্তি দেওয়া। দুই, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, ধর্ম নিয়ে রাজনীতি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও অনুষ্ঠানকে ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বন্ধ করা। সমাজে শিক্ষায় ও সংস্কৃতিতে বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতা চর্চার আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করা।


সমাবেশ সঞ্চালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস। আরও বক্তব্য দেন মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির, বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরো সদস্য আনিসুর রহমান মল্লিক, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অধ্যাপক আজিজুর রহমান, রাজিয়া সামাদ, জাতীয় শ্রমিক জোটের কার্যকরী সভাপতি আবদুল ওয়াহেদ, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সহসভাপতি রেখা চৌধুরী প্রমুখ।