ঢাকায় আচরণবিধি লঙ্ঘিত হচ্ছে প্রতিদিনই

আফতাবনগরে নির্বাচনী প্রচার শেষে টংদোকানে চা বানাতে বসে যান আতিকুল।  প্রথম আলো
আফতাবনগরে নির্বাচনী প্রচার শেষে টংদোকানে চা বানাতে বসে যান আতিকুল। প্রথম আলো

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রচারে আচরণবিধি পুরোপুরি মানছেন না প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মেয়র প্রার্থীরা। প্রচারের প্রথম দিন থেকেই রাস্তা বন্ধ করে পথসভা, নির্ধারিত সময়ের বাইরে মাইক বাজানো, প্রচারের সময় মিছিল, শোভাযাত্রাসহ আচরণবিধি লঙ্ঘনের নানা চিত্র দেখা গেছে।

যদিও সিটি করপোরেশন (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালা ২০১৬ বলছে, নির্বাচন-পূর্ব সময়ে অর্থাৎ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে ফলাফল গেজেট আকারে প্রকাশের তারিখ পর্যন্ত কোনো প্রার্থী মিছিল বা শোডাউন করতে পারবেন না। বেলা দুইটার আগে এবং রাত আটটার পরে মাইক বা শব্দের মাত্রা বর্ধনকারী অন্য যন্ত্র ব্যবহার করা যাবে না। জনগণের চলাচলের বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে, এমন কোনো সড়কে পথসভা করতে পারবেন না।

মিছিল-শোভাযাত্রা উত্তরে
ঢাকা উত্তর সিটির আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলাম গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় খিলগাঁও তালতলা মার্কেট এলাকায় নির্বাচনী প্রচার শুরু করেন। উপলক্ষে সকাল ১০টা থেকেই সেখানে একটি হলুদ রঙের পিকআপ ভ্যানে দুটি বড় কালো রঙের সাউন্ড বক্সে উচ্চ শব্দে বাজতে থাকে নৌকা প্রতীক নিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ‘থিম সং’। দেড় ঘণ্টা পর আতিকুল ইসলাম এসে সেখানে পথসভা করেন। এরপর একটি ছোট পিকআপ ভ্যানে চড়ে গণসংযোগ শুরু করেন। এ সময় মাইকে ও বড় সাউন্ড বক্সে উচ্চ স্বরে স্লোগান ও মিছিল চলতে থাকে।

এ বিষয়ে আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ রকম একটু হতে পারে। আমরা চেষ্টা করছি কোনো আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা যাতে না ঘটে। আমি বলেছি, নির্বাচনী প্রচারে যাতে জনদুর্ভোগ না হয়।’

ভোটারদের হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন তাবিথ। গতকাল তেজঁগাওয়ের তেজকুনিপাড়ায়।
ভোটারদের হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন তাবিথ। গতকাল তেজঁগাওয়ের তেজকুনিপাড়ায়।

এর আগে গত শনিবার মিরপুরের শাহ আলী (রহ.) মাজার প্রাঙ্গণে আতিকুল ইসলামের পথসভায় ঢাকা-১৪ আসনের সাংসদ আসলামুল হক ও ১৩ আসনের সাংসদ সাদেক খান যোগ দেন। যদিও আচরণ বিধিমালা অনুযায়ী, কোনো প্রার্থী বা তাঁর পক্ষে কোনো রাজনৈতিক দল কোনো মসজিদ, মন্দির গির্জা বা অন্য কোনো ধর্মীয় উপাসনালয়ে কোনো প্রকার নির্বাচনী প্রচার করতে পারবেন না। সাংসদসহ সরকারি সুবিধাভোগী অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিও নির্বাচনী প্রচারকাজে অংশ নিতে পারবেন না। এ বিষয়ে আতিকুল ইসলাম সেদিন বলেছিলেন, ‘সাংসদেরা ছিলেন, এখন নেই। চলে গেছেন। আর জায়গাটি মাজারের ভেতরে নয়।’

মিছিল ও শোভাযাত্রা করে আচরণবিধি লঙ্ঘন করে যাচ্ছেন বিএনপির প্রার্থী তাবিথ আউয়ালও। ১০ জানুয়ারি নির্বাচনী প্রচার শুরুর দিনে উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টর জামে মসজিদের সামনে বিএনপির কয়েক হাজার কর্মী-সমর্থক জমায়েত হন। তাঁরা প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে রাস্তা আটকে মিছিল করেন। গতকাল কারওয়ান বাজার এলাকায় জনসংযোগের সময়েও তাবিথের পেছনে থাকা দলীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা রাস্তাজুড়ে মিছিল করেন। এ সময় মেয়র প্রার্থীর পেছনে অন্তত ১০ থেকে ১৫টি মোটরসাইকেলের বহর দেখা যায়। তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডে তাবিথ আউয়াল বক্তৃতা দেওয়ার সময় রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

তাবিথ আউয়াল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা নির্বাচনী আইন, আচরণবিধি মেনে প্রচারণা চালাচ্ছি। জনদুর্ভোগ যেন না হয়, সে ব্যাপারেও আমরা দায়িত্বশীল আছি। চেষ্টা করছি কোনো সমস্যা সৃষ্টি না করে প্রচার চালাতে।’
তবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের রিটার্নিং কর্মকর্তা আবুল কাশেম প্রথম আলোকে বলেন, মাঠপর্যায় থেকে নিয়মিত প্রতিবেদন নেওয়া হচ্ছে। আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা কোথাও পাওয়া যায়নি।

ভোটারদের হাতে লিফলেট দিচ্ছেন ফজলে নূর তাপস। গতকাল মানিকনগরে।  প্রথম আলো
ভোটারদের হাতে লিফলেট দিচ্ছেন ফজলে নূর তাপস। গতকাল মানিকনগরে। প্রথম আলো

পথসভায় রাস্তা বন্ধ দক্ষিণে
গতকাল বেলা সোয়া একটার দিকে এভাবেই বিধি লঙ্ঘন করে নির্বাচনী গণসংযোগ শুরু করেন দক্ষিণ সিটিতে মেয়র পদে বিএনপির প্রার্থী ইশরাক হোসেন। বাসা থেকে প্রচারে বের হওয়ার সময় তাঁর সঙ্গে ছিল ১৩টি মোটরসাইকেল। আরোহীদের অনেকের মাথায় হেলমেট ছিল না। তাঁরা হর্ন চেপে অনবরত শব্দদূষণ করছিলেন। এ সময় ইশরাকের সমর্থকেরা খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি ও ধানের শীষ প্রতীকে ভোট চেয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। ইশরাকের প্রচারে এর আগেও মোটর শোভাযাত্রা, মিছিল, রাস্তা আটকে জনসংযোগ ও পথসভা করতে দেখা গেছে।

ইশরাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রচারে বের হওয়ার পর দলের নেতা-কর্মী ও স্থানীয় লোকজন যখন গণসংযোগে যুক্ত হন, তখন তাদেরও বিধি মেনে প্রচার চালানোর অনুরোধ করি। নির্বাচনের পরিবেশ যাতে বিনষ্ট না হয়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রয়েছে।’

ঢাকা দক্ষিণ সিটির আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপসও প্রতিদিন নির্বাচনী প্রচারে আছেন। ১০ জানুয়ারি ডেমরার আমুলিয়া মডেল টাউন থেকে তাঁর নির্বাচনী প্রচার শুরু হয়। ১১ জানুয়ারি ওয়ারীর রোজ গার্ডেন, ১২ জানুয়ারি শান্তিনগর কাঁচাবাজার এবং গতকাল মানিকনগর বাসস্ট্যান্ডে পথসভার মধ্য দিয়ে দিনের নির্বাচনী প্রচার শুরু করেন তিনি। পথসভায় শত শত কর্মী-সমর্থক দেখা গেছে। পথসভা শেষে তিনি হেঁটে হেঁটে প্রচারপত্র বিলি করেন। তাঁর সঙ্গে প্রতিটি এলাকায় ৫০ থেকে ৬০ জন স্থানীয় নেতা-কর্মীকে যোগ দিতে দেখা গেছে। কোনো মিছিল ছাড়াই নেতা-কর্মীরা তাপসের সঙ্গে সঙ্গে প্রচারপত্র বিলি করেন। তবে প্রতিটি এলাকায় প্রার্থী পৌঁছানোর পর নেতা-কর্মীরা স্লোগান দিয়ে তাঁকে স্বাগত জানান। গতকাল মানিকনগর এলাকায় শেখ ফজলে নূর আসার আগেই নেতা-কর্মীদের ভিড়ে যানজট তৈরি হয়। বাসস্ট্যান্ড থেকে মানিকনগর এলাকায় প্রবেশের রাস্তাটিতে গাড়ি চলাচল কার্যত বন্ধ হয়ে যায়।

সমর্থকদের নিয়ে দলীয় প্রতীক হাতে গণসংযোগে ইশরাক। পুরান ঢাকার অভয় দাস লেনে।
সমর্থকদের নিয়ে দলীয় প্রতীক হাতে গণসংযোগে ইশরাক। পুরান ঢাকার অভয় দাস লেনে।

অবশ্য প্রচার শুরুর সময় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে শেখ ফজলে নূর বলেন, আচরণবিধি মেনে সবাই সুশৃঙ্খলভাবে প্রচার চালাবেন। প্রচারের জন্য যেন রাস্তায় কোনো যানজট তৈরি না হয়।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের রিটার্নিং কর্মকর্তা আবদুল বাতেন প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয়েছে। প্রার্থীদের আচরণবিধি নজরদারিতে আছে। নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত সবার সঙ্গে বৈঠক করে আরও কঠোর নজরদারির নির্দেশনা দেওয়া হবে।