দাদনের ফাঁদে মানুষ সর্বস্বান্ত

রংপুরের তারাগঞ্জে দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা নিয়ে অনেকেই সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। সুদে-আসলে জমা টাকা পরিশোধ করতে না পেরে অনেকেই এলাকাছাড়া।

বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দাদন ব্যবসাকে কেন্দ্র করে তারাগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে গড়ে উঠেছে নামসর্বস্ব সমিতি। কৃষক-দিনমজুর ছাড়াও বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকদের চেক বন্ধক নিয়ে দাদন দেওয়া এসব সমিতির কাজ। এ ছাড়া কিছু মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের লোকজন শিক্ষকদের চেক বন্ধক নিয়ে ঋণ দিচ্ছে।

শিক্ষকেরা জানান, এসব চেক দিয়ে টাকা ব্যাংক থেকে তুলতে যাতে কোনো অসুবিধা না হয়, সে জন্য স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করে নেওয়া হচ্ছে। শিক্ষক ও চাকরিজীবী ১০ থেকে ১৫ শতাংশ সুদে চেক বই বন্ধক রেখে টাকা নেন। আর কৃষক, দিনমজুরসহ অন্য পেশার মানুষকে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ সুদে টাকা দেওয়া হচ্ছে।

সুদের টাকা শোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় দক্ষিণ মেনানগর গ্রামের নাজমুল ইসলাম ও মাটিয়ালপাড়া গ্রামের আমিনুল ইসলাম দুই বছর আগে গ্রাম ছেড়েছেন। ওই দুই গ্রামের কয়েকজন জানান, নাজমুল তাঁর মেয়ের চিকিৎসার জন্য ২০ হাজার টাকা আর আমিনুল ইকরচালী বাজারে মসলার ব্যবসা করার জন্য চড়া সুদে ২০ হাজার টাকা নেন। সুদে-আসলে তা পাঁচ গুণ হওয়ায় তাঁদের পিটিয়ে টাকা আদায়ের হুমকি দেন দাদন ব্যবসায়ীরা। পরে তাঁরা দুই বছর আগে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান। 

সাত মাস আগে উপজেলার মাঝাপাড়া গ্রামের মহিমা বেগম (৬০) তাঁর ছেলে মহুবারের চিকিৎসার জন্য মাসে ২০ শতাংশ সুদে দুই দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৭ হাজার করে ১৪ হাজার টাকা নেন। ছেলে অসুস্থ থাকার কারণে নির্ধারিত সময় তিনি ওই টাকা পরিশোধ করতে পারেননি। তাই দাদন ব্যবসায়ীরা তাঁকে প্রায়ই অপদস্থ করতেন। তিনি বাধ্য হয়ে স্থানীয় অন্য দাদন ব্যবসায়ী থেকে টাকা দেন। এতে তিনি আরও ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েন। মহিমা জানান, পরে বাধ্য হয়ে এক মাস আগে বসতভিটার সাত শতক জমি বিক্রি করেছেন। এতে কয়েকজন দাদন ব্যবসায়ীর টাকা পরিশোধ হয়। এ খবরে অন্য দাদন ব্যবসায়ীরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তাঁরা পিটিয়ে টাকা আদায়ের হুমকি দিলে ভয়ে মহিমা মেয়ের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। মহিমার ছেলে মহুবার হোসেন বলেন, ‘সুদখোরদের ভয়ে মোর মাও-বোনের বাড়িত যেয়া নুকি আছে। সুদখোররা এলা মোরটে আসি টাকা চাওছে।’

এ ছাড়া নেকিরহাট দাখিল মাদ্রাসার সুপারিনটেনডেন্ট সিরাজুল ইসলাম, তারাগঞ্জ মাদ্রাসার প্রভাষক আজিজুল ইসলাম, মেনানগর নুরুল হুদা দাখিল মাদ্রাসার সহকারী সুপার আইয়ুব আলী, মেনানগর গ্রামের বাদশা মিয়া, ডাঙ্গাপাড় গ্রামের পেটু মিয়াসহ অনেকে চক্রবৃদ্ধি সুদের কবলে পড়ে সহায়-সম্বল বিক্রি করে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। 

ইকরচালী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য রবিউল ইসলাম বলেন, তারাগঞ্জে পাঁচটি ইউনিয়নে শতাধিক সমিতি গড়ে উঠেছে, যারা দাদনের ব্যবসা করছে। পাশাপাশি মধ্যবিত্ত পরিবারের কিছু লোকজন দাদন ব্যবসা করছেন। সুদ-আসলের টাকা আদায়কে কেন্দ্র করে মাসে তিন-চারজন দেনাদারকে মারপিটের ঘটনাও ঘটছে। সুদের টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে অনেকেই সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। অনেকে ভয়ে এলাকাছাড়া।

ইকরচালী ইউনিয়নের মাঝাপাড়া গ্রামের মন্টু মিয়া দাদন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি দাদন (সুদের ব্যবসা) করি না। আর সুদখোরেরা তো জোর করে কাউকে টাকা দেয় না। বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্যই মানুষ অনুরোধ-বিনুরোধ করে সুদখোরদের কাছে টাকা নেয়। এ জন্য সুদখোরেরা যা নেয়, তা উপকারের ফল। এতে দোষ কী?’

জানতে চাইলে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা শাহিনুর ইসলাম বলেন, ‘দাদন ব্যবসায়ীর খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব হওয়ার কথা লোকমুখে শুনেছি। কিন্তু কোন কোন সমিতির নামে ওই ব্যবসা চলছে, তা সুনির্দিষ্ট করে কেউ অভিযোগ করেনি। অভিযোগ করলে তদন্ত করে ওই সমিতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

তারাগঞ্জ থানার ওসি জিন্নাত আলী বলেন, দাদন ব্যবসা বেআইনি। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে দাদন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।