বিরোধী মতের কণ্ঠ রোধ করছে সরকার: এইচআরডব্লিউ, নির্লজ্জ মিথ্যাচার বললেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার বিরোধী মতের কণ্ঠ রোধ করছে বলে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। সংস্থাটি আরও বলেছে, নির্যাতনের অভিযোগ থাকলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জবাবদিহির আওতায় আনতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার।

তবে সরকারের পক্ষ থেকে এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে তথ্য প্রতিমন্ত্রী মো. মুরাদ হাসান বলেছেন, ‘এসব কথা বলে নির্লজ্জ মিথ্যাচার করেছে এইচআরডব্লিউ। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সরকারের প্রশ্ন আছে।’

এইচআরডব্লিউর ‘বৈশ্বিক রিপোর্ট ২০২০’–এ এসব মন্তব্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে ২০১৯ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির মূল্যায়ন উঠে এসেছে। গতকাল মঙ্গলবার এ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২০১৯ সালে বাংলাদেশ ২০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো তার চর্চা নিয়ে নির্যাতনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের কমিটির পর্যালোচনায় অংশগ্রহণ করে। কিন্তু কমিটি যখন জোরপূর্বক অন্তর্ধান ও নির্যাতনের বিষয়ে বাংলাদেশকে চাপ প্রয়োগ করল—যেগুলো নিয়ে মানবাধিকার সংস্থাগুলো নিয়মিতভাবে প্রতিবেদন করছে—সরকার তখন সব অভিযোগ অস্বীকার করে। এদিকে ক্রসফায়ারের সময় এসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বেআইনি হত্যাকাণ্ডের মতো ভয়াবহ নির্যাতন দায়মুক্তি নিয়েছে। ২০১৯ সালে মাইকেল চাকমাসহ (ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিকারকর্মী) কমপক্ষে ২৪ জন জোরপূর্বক অন্তর্ধান হয়েছেন।

এইচআরডব্লিউর এশিয়া পরিচালক ব্রাড অ্যাডামস এ কথা বলেছেন, ‘কর্তৃত্ববাদিতার দিকে ক্রমবর্ধমানভাবে ঝুঁকে যাওয়ার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের উদ্বেগের মধ্যেই বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সংসদে ৯৬ শতাংশ আসন লাভের মাধ্যমে সরকার গঠন করে। মানবাধিকারের প্রতি সরকারের সম্মানের বিষয়ে আন্তর্জাতিক ও জনমানুষের আস্থা ফেরানোর উদ্যোগ গ্রহণের পরিবর্তে ক্ষমতাসীন দল সুশীল সমাজের ওপর কঠোর হয়েছে।’

এইচআরডব্লিউর এ প্রতিবেদন প্রসঙ্গে তথ্য প্রতিমন্ত্রী মো. মুরাদ হাসান বলেন, ‘এই অভিযোগ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছে সরকার। বিরোধী মতের কণ্ঠ রোধ করা মতো কোনো অভিপ্রায় নেই, দরকার নেই। টেলিভিশন খুললে বিএনপির মির্জা ফখরুলসহ অনেক নেতার শত শত ইভেন্ট চোখে পড়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা মিথ্যাচার করে যাচ্ছে। এসব কি এইচআরডব্লিউর চোখে পড়ে না?’

প্রতিবেদনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী মুরাদ বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উদার ভূমিকা নিয়েছে। হাইকোর্টের সামনে বিএনপি যে ভাঙচুর করল, তা তাদের চোখে পড়ে না? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কয়েকজনকে ধরেছে? উলটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে বিএনপির কর্মীরা। কোথায় অত্যাচার করল? তারা অন্যায় আন্দোলন করবে। খালেদা জিয়া গুলশানে বসে অবরোধ করে রাখল। জ্বালাও-পোড়াও, মানুষ হত্যা—এসব যখন হয়েছিল, তখন মানবাধিকারের ধ্বজাধারীরা কোথায় ছিলেন?’

তথ্য প্রতিমন্ত্রী মো. মুরাদ হাসান। ছবি: সংগৃহীত
তথ্য প্রতিমন্ত্রী মো. মুরাদ হাসান। ছবি: সংগৃহীত

৬৫২ পৃষ্ঠার বৈশ্বিক প্রতিবেদন ২০২০–এর ৩০তম সংস্করণে এইচআরডব্লিউ প্রায় ১০০টি দেশের মানবাধিকার চর্চা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেছে। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক কেনেথ রথ তাঁর প্রারম্ভিক প্রবন্ধে বলেছেন, দমন-পীড়নের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকা চীন সরকার বিগত কয়েক দশকের মধ্যে বিশ্ব মানবাধিকার ব্যবস্থায় সবচেয়ে তীব্র আঘাত হানছে। তাঁর মতে, বেইজিংয়ের কার্যক্রম সারা বিশ্বের স্বৈরতান্ত্রিক ও লোকরঞ্জনবাদী সরকারগুলোর কেবল সমর্থনই লাভ করছে না, বরং তাদের উৎসাহিতও করছে।

গত মার্চ মাসে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে ধর্মঘটের পরে কমপক্ষে সাড়ে সাত হাজার পোশাক শ্রমিককে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে, যা বিগত কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশে শ্রমিক নির্যাতনের সবচেয়ে বড় ঘটনা।

এ প্রসঙ্গে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি এম এ মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘শ্রমিক নির্যাতনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। কোনো মালিক যখন ব্যর্থ হয়ে যান, শিল্প বন্ধ করে দিতে ব্যর্থ হন, তখন এটাও ওই মালিকের অধিকার, শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা দিয়ে বিদায় করে দেওয়ার। কোনো মালিক যদি শ্রমিকদের বঞ্চিত করার চেষ্টা করেন, তখন এর বিরুদ্ধে আমরা দাঁড়াই।’

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে সরকারের সমালোচনা করলেও রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের প্রশংসা করে এ সংগঠন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে আগত প্রায় ১০ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় প্রদানকারী দেশ বাংলাদেশ। গুরুতর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও পরিবেশগত চাপ সত্ত্বেও শরণার্থীদের জোরপূর্বক প্রত্যাবাসন না করানোর আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশ রক্ষা করেছে। তবে বাংলাদেশ সরকারের নীতি ও নিরাপত্তা বাহিনীর নিপীড়নের ফলে শরণার্থীশিবিরের অবস্থার অবনতি হয়েছে।’

রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘পলি মাটি জমে সৃষ্টি হওয়া ভাসানচরের বসবাসযোগ্যতা নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ বারবার শরণার্থীদের চরটিতে স্থানান্তরের হুমকি দিয়েছে।’

প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘মার্চে বাংলাদেশ মিয়ানমারের জাতিগত রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রাথমিক অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রথম মিশনকে স্বাগত জানায় আর নভেম্বরে আদালত তদন্ত শুরুর অনুমতি দেন।’