সম্রাটসহ ৭ বন্দী হাসপাতালে শুয়েবসে জেল খাটছেন

‘বুকে ব্যথা’ নিয়ে ভর্তি হয়ে টানা প্রায় দুই মাস বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) আছেন সাম্প্রতিক ক্যাসিনো–কাণ্ড আর শুদ্ধি অভিযানে আটক যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাট।

সম্রাট একা নন। তিনিসহ ঢাকার কেরানীগঞ্জ ও কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের আলোচিত-সমালোচিত সাত বন্দী এখন হাসপাতালের বিছানায় শুয়েবসে জেল খাটছেন। এক-দুদিন নয়, তাঁদের হাসপাতালবাসের মেয়াদ নিচে ২ থেকে ওপরে ১১ মাস পর্যন্ত গড়িয়েছে। তাঁরা সবাই গুরুতর বড় বড় মামলার আসামি।

কয়েকটি দুর্নীতির মামলায় কারাবন্দী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তাঁদের একজন। তবে তাঁর দীর্ঘ অসুস্থতার কথা বহুল আলোচিত। তবে তালিকায় আরও আছেন সোনা চোরাচালান মামলার আসামি খাজা শাহাদাত উল্লাহ, টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের মামলার আসামি ডেসটিনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমিন ও ইয়াবা কারবারের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আমিন হুদা। দুজন আছেন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আসামি জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) মো. ওহিদুল হক ও মো. আবদুল জলিল মিয়া।

প্রভাবশালী আসামিদের হাসপাতালে কারাবাস অবশ্য নতুন কিছু নয়। সংবাদমাধ্যমে লেখালেখি হলে জেলে ফিরতে হয়। আবার আমিন হুদার মতো কেউ কেউ ফিরে ফিরে হাসপাতালে ঠাঁই পান। একজন কারা চিকিৎসক প্রথম আলোকে বলেছেন, এই সাতজনের তিনজন আসলেই অসুস্থ। কাউকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের পরামর্শে।

এই প্রবণতা কেবল ঢাকারও নয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেওয়া কারা অধিদপ্তরের মাসিক প্রতিবেদন বলছে, গত ডিসেম্বরে দেশজুড়ে মোট ১০৭ জন আসামি বা সাজাপ্রাপ্ত বন্দী চিকিৎসার জন্য কারাগারের বাইরে হাসপাতালে ছিলেন। কারা অধিদপ্তরের উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র বলেছে, ঢাকার বাইরে ৬৫টি কারা হাসপাতালে চিকিৎসক নেই। সেখানকার বন্দীদের চিকিৎসার জন্য বাইরের হাসপাতালে পাঠানোর একধরনের যুক্তি রয়েছে। এখানকার সাতজনের মধ্যে অন্তত চারজনের অসুস্থতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

সাতজনের মধ্যে ছয়জনই আছেন বিএসএমএমইউ হাসপাতালে। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক (হাসপাতাল) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে মাহবুবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, রোগী সুস্থ হলে ছাড়পত্র দিয়ে দেওয়ার কথা। তবে এত দিন ধরে তাঁরা কেন হাসপাতালে আছেন, তা তাঁদের চিকিৎসকেরাই বলতে পারবেন।

সন্দেহজনক অসুস্থতা
সম্রাট গ্রেপ্তার হয়েছিলেন খেলার ক্লাবে ক্যাসিনো পরিচালনার বিরুদ্ধে অভিযানের সুবাদে। তিনি বন্য প্রাণী ও মাদক আইনের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। এ ছাড়া মাদক ও অস্ত্র আইনে আর অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা রয়েছে। র‌্যাব গত ৬ অক্টোবর তাঁকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়। এক দিন পরই কারা কর্তৃপক্ষ তাঁকে জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউটে ভর্তি করে।

>প্রকৃত অসুস্থ দুই-তিনজন
আমিন হুদাসহ বাকিরা রোগীর সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন
ওপর মহলের হাত থাকার কথা বলেছেন কারা চিকিৎসক

সেখানে এক সপ্তাহ থাকার পর সমালোচনার মুখে সম্রাটকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফেরত পাঠানো হয়। নিরাপত্তা বিবেচনায় পরে সম্রাটকে কাশিমপুর হাই-সিকিউরিটি কারাগারে পাঠানো হয়। সেখান থেকে গত ২৪ নভেম্বর আবার তাঁকে বিএসএমএমইউতে ভর্তি করা হয়। এখন তিনি সেখানকার নিবিড় পরিচর্যা ও সাধারণ সেবার মধ্যবর্তী ইউনিট এসডিইউতে আছেন।
সম্রাটের চিকিৎসক চৌধুরী মেসকাত আহম্মেদ প্রথম আলোকে বলেন, দেশের বাইরে ছিলেন, রোগীর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানেন না। তবে রোগীর যে সমস্যা, তাতে যেকোনো সময় সংকট হতে পারে। তাই মেডিকেল বোর্ড সম্রাটকে হাসপাতালের কারা সেলে রাখতে বলেছেন। কিন্তু এসডিইউতে কেন রাখা হয়েছে, তা তিনি জানেন না।

কারাগার-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ইয়াবা ব্যবসায়ী আমিন হুদা সাজা হওয়ার পর জেলে আছেন সাড়ে ছয় বছর। এর মধ্যে কারা কর্তৃপক্ষ তাঁকে হাসপাতালে রেখেছে প্রায় আড়াই বছর। টানা ১৯ মাসও তিনি হাসপাতালে থেকেছেন। কখনো পিঠে ব্যথা, কখনো বুকে ব্যথার কথা বলেছেন। গত এপ্রিলে তাঁকে পাঠানোর যুক্তি ছিল, আত্মহত্যার ঝুঁকি এড়ানো এবং বিষণ্নতা দূর করা। এ নিয়ে পত্রিকায় খবর হলে তাঁকে জেলে ফিরতে হয়েছিল।

তারপর আমিন হুদার মা নূরজাহান হুদা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে ছেলের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে বলেন। তিনি লেখেন, কারাগারে উপযুক্ত চিকিৎসা হচ্ছে না। আদালতের নির্দেশে গত ১ আগস্ট স্বাস্থ্যগত অবস্থার প্রতিবেদনের জন্য আমিন হুদাকে আবার বিএসএমএমইউতে ভর্তি করা হয়। প্রায় ছয় মাস হলো তিনি হাসপাতালে আছেন, প্রতিবেদনটি এখনো হয়নি। কারা প্রতিবেদনে ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা ও হৃদ্রোগের কথা লেখা।

২০০৭ সালের ২৪ অক্টোবর আমিন হুদা মাদকসহ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের দুটি মামলায় ২০১২ সালের ১৫ জুলাই তাঁর মোট ৭৯ বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়। ২০১৩ সালের ৫ মে আপিল বিভাগ তাঁর জামিন বাতিল করেন। সেই থেকে তিনি কারাগার আর হাসপাতালের চক্কর কাটছেন।

খাজা শাহাদাত উল্লাহ টানা প্রায় চার মাস হাসপাতালের বিছানায় দিন পার করছেন। তাঁর জটিল কোনো রোগের কথা জানা যায়নি। কারাগারের কাগজপত্রে লেখা আছে, ‘মলদ্বার দিয়ে রক্তক্ষরণ’। এর আগেও তিনি সাড়ে তিন মাস হাসপাতালে থেকে গেছেন। সে সময় কারাগারের কাগজপত্রে লেখা ছিল ‘ইনফেকশন, লো ব্যাক পেইন’।

বাংলাদেশ তাইওয়ান সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান খাজা শাহাদাত আছেন বিএসএমএমইউ হাসপাতালের কারাকক্ষে। গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফেরার পর ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাঁর মালামাল তল্লাশি করে প্রায় ১৩ কেজি সোনা পাওয়া গিয়েছিল। সোনা চোরাচালানের অভিযোগে ওই দিনই তাঁর বিরুদ্ধে মামলাটি হয়। সরকারের এক ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীর সমর্থন রয়েছে তাঁর প্রতি।

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আসামি এনএএসআইয়ের সাবেক ডিজি ওহিদুল হক ২০১৮ সালের এপ্রিলে গেপ্তার হন। কারাগারে তিনি
শ্রেণিপ্রাপ্ত হাজতি। গত ২০ নভেম্বর থেকে তিনি বিএসএমএমইউতে আছেন।

অসুস্থতা ও অন্যান্য কারণ
ঢাকা বিভাগের কারা উপমহাপরিদর্শক টিপু সুলতান বলছেন, হাজতি ও কয়েদিদের চিকিৎসার প্রয়োজনে বাইরের হাসপাতালে পাঠানো হয়। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, এর মধ্যে কোনো প্রভাব খাটানো বা অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয় নেই।

কারাগারের নথিপত্র বলছে, গত ১১ মার্চ ডেসটিনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমীনকে বিএসএমএমইউতে ভর্তি করা হয়। এ যাত্রায় তাঁর হাসপাতালবাসের মেয়াদ ১১ মাস হতে চলেছে। রফিকুল হৃদ্রোগে আক্রান্ত হলে তাঁকে দুটি স্টেন্ট বা রিং পরানো হয়েছে।

কারা নথি অনুযায়ী, ২০১২ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার পর রোগী হিসেবে বেশির ভাগ সময় রফিকুল বারডেম ও বিএসএমএমইউ হাসপাতালে থেকেছেন। প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে তিনিসহ ডেসটিনি গ্রুপের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলা বিচারাধীন।

সাজাপ্রাপ্ত হাজতি ও কয়েদিদের বাইরের হাসপাতালে নেওয়ার সুপারিশ করেছেন কারা চিকিৎসক মাহমুদুল হাসান ও মো. খুরশীদ আলম। ডা. মাহমুদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, খালেদা জিয়া ও রফিকুল আমীন আসলেই অসুস্থ। আমিন হুদাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে আদালতের নির্দেশে। খাজা শাহাদাত উল্লাহকে কারাগারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশে হাসপাতালে রাখা হয়েছে, কারা চিকিৎসকেরা তাঁর জন্য কোনো সুপারিশ করেননি। তাঁর তেমন কোনো রোগের কথা তাঁদের জানা নেই। আর ইসমাইল হোসেন সম্রাটকে পাঠানো হয়েছে কাশিমপুর কারাগার থেকে।

গণহত্যা, নারী নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আসামি আবদুল জলিল মিয়া গ্রেপ্তার হন ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে। কারা প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিনি গত ১২ নভেম্বর ভাঙা কোমর নিয়ে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) ভর্তি হয়েছেন।

ডা. মাহমুদুল বলছেন, সত্তরোর্ধ্ব জলিল মিয়া অসুস্থ। কিন্তু একই অপরাধের মামলার আসামি ওহিদুল হককে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে।

কারাগারের সাবেক উপমহাপরিদর্শক গোলাম হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, উচ্চপর্যায়ের দোহাই দিলে চলবে না। কারাবন্দীদের এভাবে টানা হাসপাতালে থাকাটা অস্বাভাবিক। কারা কর্তৃপক্ষের উচিত চিঠি দিয়ে হাসপাতাল থেকে আসামিদের ফেরত চাওয়া।