'কত দিন রঙিন কাগজে মোড়ানো গিফট পাই না'

‘জন্মদিনে সকালে ঘুম থেকে জাগার পর পরিবারের সদস্যরা বলবে শুভ জন্মদিন। বাড়িতে কেক আসবে। কেক কাটা হবে। একসময় হতোও তাই। সেই ১৯৯১ সালে ঘটা করে শেষ জন্মদিন পালন করা হয়েছিল। মা পূজা দিতে মন্দিরে গিয়েছিলেন। এখন আর হয় না। কত দিন রঙিন কাগজে মোড়ানো কোনো গিফট পাই না। এই জীবনে হয়তো আর পাব না।’

কথাগুলো বললেন অনন্যা বণিক। তিনি নিজেকে হিজড়া হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। গতকাল বুধবার ছিল তাঁর ৪২তম জন্মদিন। ঢাকার কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে বললেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের কিছু বন্ধু জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। চার ভাই (তিনিসহ) আর পাঁচ বোনের মধ্যে অনন্যা আর তাঁর এক বোন দেশে আছেন। ওই বোন সমাজ ও পরিবারের নানান গঞ্জনা সহ্য করেও অনন্যাকে কাছে রেখেছেন, জন্মদিনে এই বোনের প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন অনন্যা।

বাড়ি থেকে অনন্যার নাম দেওয়া হয়েছিল গৌতম বণিক। অ্যাফিডেভিট করে অনন্যা হয়েছেন। বোনের ছেলেমেয়েরা এখনো মামা বলেই ডাকে। সাভারের ধামরাইতে বোনের সঙ্গে থাকলেও পারিবারিক অনুষ্ঠানে নিজেকে লুকিয়ে রাখেন অনন্যা। কেননা অনন্যা চান না তাঁর জন্য বোনের পরিবার কোনো বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হোক।

বনেদি পরিবারে অনন্যার জন্ম। পুরান ঢাকায় তাঁদের বাড়িতে রেডিও শুনতে আশপাশের মানুষ ভিড় করত। অনন্যার বাবা ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলেন, আর মা পালকিতে চড়ে যাতায়াত করতেন। নিজেদের গোয়ালের গরুর দুধ খেতেন। তবে সবকিছুই এখন অতীত।

জন্মদিন বলেই হয়তো অনন্যা বারবার ফিরে যাচ্ছিলেন তাঁর ছোটবেলায়। বাড়িতে বড় পরিসরে পূজা হতো। সেখানে অনন্যা নাচতেন। বাহবাও পেতেন। তবে বাবা শুধু বলতেন, ছেলেটা কেন এমন হলো? যদিও তাতে আদরের কমতি হতো না। ছোট সন্তান হওয়ায় বেশ বড় হয়েও বাবার কাঁধে চড়েছেন অনন্যা। বাবা মারা যাওয়ার পর মায়ের সঙ্গে না ঘুমালে ঘুম হতো না। তবে বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই শুরু হয় অনন্যার সংগ্রাম। মা থাকলেও ভাইয়েরা বাড়িতে থাকতে দিতে চাননি। ভাইদের কথা ছিল, বাড়িতে থাকতে হলে গৌতম হয়েই থাকতে হবে। তাই বাড়ি ছাড়তে হয়।

অনন্যা বললেন, ‘দাদাদের বন্ধুর চেয়ে দিদিদের বান্ধবীরা এলে তাঁদের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালো লাগত। দিদিদের ফ্রক বা মায়ের নতুন শাড়ি আয়নার সামনে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতাম। আর আয়নায় তো কখনো গৌতমকে দেখতাম না। তাই গৌতম হয়ে থাকা হলো না। হিজড়া কমিউনিটিতে গিয়ে মাকে ছাড়া ঘুমাতে গিয়ে কত দিন যে ঘুমাতে পারি নাই, তার ঠিক নেই। রাতে ঘুম থেকে জেগে মাকে খুঁজতাম।’

অনন্যার বাবা ১৯৯২ সালে আর মা ২০১০ সালে মারা যান ।

অনন্যা বললেন, ‘দাদারা বাড়ি থেকে বের করে দিলেও মা মারা যাওয়ার সময় হাসপাতালে মায়ের পাশে আমিই ছিলাম। আমিই ওদের ফোন করে মায়ের মারা যাওয়ার খবর দিয়ে বলেছিলাম, ‘আমি তোমাদের হিজড়া ভাই বলছি। গৌতম থেকে অনন্যা হওয়ার কারণেই আমার নামের যে সম্পত্তি ছিল, তা বেহাত হয়ে গেছে। বোনের এক ছেলে নিজেকে “গৌতম” বানিয়ে সম্পত্তির মালিক হয়েছে। তবে এই সমাজে নারী-পুরুষের প্রতিযোগিতার ভিড়ে আমি অনন্যা হিজড়া ভালো আছি। হিজড়া বলেই আমি আমার অবস্থানে আসতে পেরেছি।’

অনন্যার ব্যস্ততা বেড়েছে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান হিজড়া এবং বেদে সম্প্রদায়ের কর্মসংস্থান ও পুনর্বাসনে উত্তরণ ফাউন্ডেশন পরিচালনা করছেন ২০১৬ সাল থেকে। এ ফাউন্ডেশনের অধীনে সাভারের ধামরাই, নবীনগর, হেমায়েতপুর, মানিকগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাঁচটি বিউটি পারলার পরিচালিত হচ্ছে। এই বিউটি পারলারগুলোর তত্ত্বাবধানে আছেন অনন্যা বণিক। হিজড়াদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, বিউটি পারলারে যে নারীরা সাজতে আসেন, তাঁদের সাজানোর তদারকি করাসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন অনন্যা। প্রতিদিন গড়ে ১৫ জন নারী আসেন সাজগোজ, চুল কাটানোসহ বিভিন্ন দরকারে।

অনন্যা
অনন্যা

পারলার পরিচালনার অভিজ্ঞতায় অনন্যা বললেন, ‘অনেক নারী ভেতরে ঢুকেই বলেন—“ওহ হিজড়ারা সাজাচ্ছে, এখানে সাজব না।” আবার অনেকে ফোন করে অনন্যা পারলারে আছেন, তা জেনে তারপরই আসেন। হিজড়াদের বিকল্প কর্মসংস্থান হিসেবে পারলারগুলো একসময় ইনস্টিটিউশনে পরিণত হবে বলেই আমার বিশ্বাস।’

অনন্যা বেশ গর্ব করেই বললেন, ‘উত্তরণ ফাউন্ডেশনের সহায়তায় শাম্মী ও নিশাত ভারতে গিয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন হেয়ার স্টাইল বিশেষজ্ঞ জাবেদ হাবিবের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন। উত্তরণ ফাউন্ডেশনের অধীনে প্রশিক্ষণ নিয়ে কেউ আলাদাভাবেও নিজস্ব পারলার পরিচালনা করতে পারেন। তবে পুঁজির অভাবে তা করাটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।’

অনন্যার আজকের অনন্যা হয়ে ওঠার পেছনে বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির অবদান আছে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর থেকেই বিভিন্নভাবে পাশে দাঁড়িয়েছে এ সংগঠন।

নৃত্যশিল্পী হিসেবে অনন্যার আরেকটি পরিচয় আছে। তিনি বুলবুল ললিতকলা একাডেমি থেকে নাচের ওপর ডিপ্লোমা করেছেন। তিনি ক্ল্যাসিক্যাল নৃত্য করেন। বিভিন্ন থিম ধরে পারফর্মিং আর্টও করেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের তিনি বি গ্রেডের তালিকাভুক্ত নৃত্যশিল্পী। এই নাচের জন্যই তিনি ভারত, নেপাল, মালয়েশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ডসসহ বিভিন্ন দেশে গেছেন। বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির নাচের দল (হিজড়া এবং সাধারণ নৃত্যশিল্পীরা একসঙ্গে নাচেন) সত্তার হয়েও বিভিন্ন নাচের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। এ সত্তার হয়ে কক্সবাজারে ওশান ড্যান্স ফেস্টিভ্যালে ‘দ্য বিউটিফুল বাংলাদেশ’ শিরোনামে নৃত্যে অংশ নিয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছেন অনন্যা। এতে ১৭টি দেশের নৃত্যশিল্পীরা অংশ নিয়েছিলেন। ২০১০ সালে জার্মান কালচারাল সেন্টার এবং বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি আয়োজিত হিজড়া সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অনন্যা দ্বিতীয় হন। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশেও (আইসিডিডিআরবি) কাজ করেছেন অনন্যা। ২০১০ সালে হিজড়াদের পরিসংখ্যান বের করার জন্য আইসিডিডিআরবির চালানো জরিপে (সার্ভে) তত্ত্বাবধায়ক (সুপারভাইজার) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

উচ্চমাধ্যমিকের পর আর পড়া হয়নি অনন্যার। এই আক্ষেপ থেকেই অনন্যা বললেন,‘আমি হিজড়া। সৃষ্টিকর্তা আমাকে এভাবে তৈরি করেছেন। প্রতিবন্ধী শিশুদের পরিবার থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না, কিন্তু আমাদের পরিবার থেকে বের করে দিচ্ছে। আর পরিবার থেকে ছিটকে পড়ে পথে নামতে হয় হিজড়াদের। পরিবারেই হিজড়ারা থাকার সুযোগ পেলে তারা পড়াশোনা থেকে ঝরে পড়বে না। সমাজে তারাও অবদান রাখতে পারবে। কর্মসংস্থানের অভাবেই হিজড়ারা ভিক্ষাবৃত্তিসহ বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতে বাধ্য হচ্ছে।’

অনন্যা বলেন, হিজড়াদের প্রতি পদে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। বাড়িওয়ালারা বাড়ি ভাড়া দিতে চান না, দিলেও বাড়তি ভাড়া আদায় করেন। গণপরিবহনে উঠলে শুনতে হয় ‘হাফ লেডিস’। হিজড়া বলে পাশে কেউ বসতে চান না। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছে। ২০১৩ সালে নারী-পুরুষের পাশাপাশি হিজড়াদের স্বীকৃতি দেয় সরকার। এতে করে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটছে, তবে সেই পরিবর্তনের গতিটা অনেক ধীর।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে দেশে হিজড়া জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১৫ হাজার। আর অনন্যাদের মতে, এ সংখ্যা দেড় লাখ। পরিসংখ্যানগত বিভ্রান্তির অবসান চান অনন্যা। হিজড়াদের কল্যাণে সরকার কোনো কর্মসূচি নিলে হিজড়া জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কথা বলেই যাতে তা বাস্তবায়ন করা হয়, সে প্রত্যাশাও করেন অনন্যা।

জন্মদিনের প্রসঙ্গ দিয়েই আলাপচারিতা শেষ করলেন অনন্যা। বললেন,‘কল্পনায় আমি আমার আগের জন্মদিনগুলোতে ফিরে যাই। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আবার ঘটা করে জন্মদিন উদযাপন করতে চাই।’