নবজাতকের মৃত্যুর প্রধান তিন কারণ

দেশে গত কয়েক বছরে নবজাতকের মৃত্যুহার বেড়েছে। এই হার বেড়েছে মূলত জন্মের সময় শ্বাসরুদ্ধ হওয়া, জীবাণুর বিষক্রিয়ায় পচন, সংক্রামক রোগ ও কম ওজনের মতো প্রতিরোধযোগ্য কিছু কারণে। এসব সমস্যা মোকাবিলায় সরকারের নেওয়া কর্মসূচি অপ্রতুল, চলছে ঢিলেঢালাভাবে।

বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) দেশের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক সবচেয়ে বড় জরিপ। সর্বশেষ ২০১৭-১৮ সালের জরিপটি বলছে, ১ হাজার শিশু জন্ম নিলে ২৮ দিন বয়স হওয়ার আগে, অর্থাৎ নবজাতক পর্যায়েই তাদের ৩০টি মারা যাচ্ছে। ২০১৪ সালে হাজারে দুটি নবজাতক কম মারা যেত।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক শামস্ এল আরেফিন প্রথম আলোকে বলেন, নবজাতকের জীবন রক্ষার সুনির্দিষ্ট উপায় এখন জানা। অথচ সরকারের নেওয়া কর্মসূচির পরিসর খুব কম। এগুলোর তেমন প্রভাব বা ফল দেখা যাচ্ছে না।

বিডিএইচএস অনুযায়ী সার্বিকভাবে শিশুমৃত্যু, অর্থাৎ পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুহার অবশ্য সামান্য কমেছে। প্রতি হাজার জন্মে এখন মৃত্যুর সংখ্যা ৪৫, গতবার ছিল ৪৬। তবে এ মৃত্যুর বড় অংশটিই নবজাতক পর্যায়ের। মোট মারা যাওয়া শিশুর প্রায় ৭০ শতাংশ নবজাতক। এভাবে এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই হাজারে ৩৮টি শিশু মারা যাচ্ছে।

একাধিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় এই জরিপ নিয়মিত করে আসছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট)। আবার সরকারেরই আরেক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, নবজাতক বা শিশুমৃত্যুর হার অনেক কম। বিবিএসের সর্বশেষ ২০১৮ সালের স্যাম্পেল ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন স্ট্যাটিসটিকস (এসভিআরএস) অনুযায়ী, নবজাতকের মৃত্যুহার হাজারে ১৬ এবং পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হার ২৯।

তবে এসভিআরএস ছোট পরিসরের জরিপ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ আর পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, তাঁরা পদ্ধতিগত ও ধারাবাহিকতার বিচারে বিডিএইচএসের পরিসংখ্যানে বেশি আস্থা রাখেন। এই জরিপের তথ্য আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বেশি ব্যবহৃত হয়।

জাতিসংঘ শিশু তহবিল বা ইউনিসেফের গত ৩১ ডিসেম্বরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিদিন ৮ হাজারের বেশি শিশু জন্ম নিচ্ছে। সেই হিসাবে বছরে জন্ম নেয় ২৯ লাখের বেশি শিশু। বিডিএইচএসের হারে হিসাব করলে গড়ে নবজাতকের মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াবে ৮৮ হাজারের বেশি।

মৃত্যুর কারণ ও সরকারের ব্যবস্থা
বিডিএইচএসের প্রতিবেদন বলছে, নবজাতক মৃত্যুর এক-চতুর্থাংশ ঘটে জন্মকালীন শ্বাসরোধের কারণে। প্রায় সমান ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ সেপসিস বা জীবাণুর বিষক্রিয়াজনিত পচন, নিউমোনিয়া বা অন্য কোনো সংক্রমণ। ১৭ শতাংশ মৃত্যু ঘটছে অপরিণত জন্ম এবং জন্মের সময় কম ওজন হওয়ার কারণে।

মাঠে এখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের বেশ কিছু কর্মসূচি চলছে। চিকিৎসক শামসুল হক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য কর্মসূচির পরিচালক। তিনি নিরাপদ প্রসবসেবা, নবজাতকের শ্বাসরোধ দূর করতে ‘হেলপিং বেবিস ব্রেথ’ কর্মসূচি, নাভি বা নাড়ি পরিচর্যার ওষুধ সরবরাহ, কম ওজনের নবজাতকের জন্য ক্যাঙারু মাদার কেয়ারের মতো কার্যক্রমের বর্ণনা দিলেন।

তবে মাঠের অভিজ্ঞতা বলছে, এসব কর্মসূচি বা প্রকল্প খুব বেশি মানুষের কাছে পৌঁছায়নি। এটা স্বীকৃত সত্য যে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রসব হলে নবজাতকের মৃত্যুহার কমে। কিন্তু বিডিএইচএস বলছে, শিশুদের অর্ধেকের বেশি জন্ম নিচ্ছে বাড়িতে। বাকিরা হাসপাতাল, ক্লিনিক বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে জন্মানোর সুযোগ পাচ্ছে।

বাড়িতে ৯৪ শতাংশ প্রসব হচ্ছে অপ্রশিক্ষিত সেবাদানকারীর হাতে। এ ক্ষেত্রে জটিলতা এবং মা ও শিশু উভয়েরই মৃত্যুঝুঁকি বেশি। হাসপাতাল, ক্লিনিক বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে জন্ম নেওয়া শিশুদের দুই-তৃতীয়াংশ আবার জন্ম নিচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্যবিষয়ক একজন গবেষক প্রথম আলোকে বলেন, বেসরকারি অনেক ক্লিনিকে প্রসব মানেই অস্ত্রোপচার। অস্ত্রোপচারের পর জটিলতা দেখা দিলেই তাঁরা বড় হাসপাতালে রোগী স্থানান্তরের পরামর্শ দেন। ফলে প্রায় দেখা যায়, রাস্তায়ই নবজাতক মারা যায়।

জরিপ বলছে, বার্থ অ্যাস্ফিক্সিয়া বা জন্মকালীন শ্বাসরোধ হওয়াটা বড় সমস্যা। এর মোকাবিলার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সারা দেশের মাঠকর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। সর্বস্তরের সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানে বিশেষ ব্যাগ ও মুখোশ সরবরাহ করেছে।

কিন্তু ২০১৭ সালের স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান জরিপে দেখা গেছে, সরকারি প্রায় ৮০ ভাগ প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষিত কর্মী দিয়ে শ্বাসরুদ্ধ নবজাতকের জ্ঞান ফিরিয়ে আনার চর্চা নেই। জরিপের সময় অর্ধেকের কিছু বেশি প্রতিষ্ঠানে সহায়ক ব্যাগ ও মুখোশ পাওয়া গিয়েছিল।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নবজাতকের সেপসিস বা জীবাণুর বিষক্রিয়াজনিত পচনের জন্য সেবাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অ্যান্টিবায়োটিক সরবরাহ করছে। এর মধ্যে আছে খাওয়ার অ্যামোক্সিসিলিন এবং ইনজেকশনের মাধ্যমে দেওয়া যায় এমন জেন্টামাইসিন। তবে এসব ওষুধের মজুত পরিস্থিতি খারাপ।

২০১৪ সালের একই জরিপে ৮০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে অ্যামোক্সিসিলিন পাওয়া যায়, ২০১৭ সালে পাওয়া যায় ৬৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে। ২০১৪ সালে ১৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে জেন্টামাইসিন পাওয়া যায়, ২০১৭ সালে পাওয়া যায় ১৬ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে। অর্থাৎ নবজাতকের জীবন রক্ষাকারী ওষুধের প্রাপ্যতা ক্রমেই কমছে।

বিডিএইচএসের প্রতিবেদন বলছে, দেশে প্রায় এক-চতুর্থাংশ শিশু জন্মায় কম ওজন নিয়ে। জন্মানোর সময় এদের ওজন থাকে আড়াই কিলোগ্রামের কম। অর্থাৎ এদের শরীরে তাপ থাকে কম। বুকের দুধ টেনে খাওয়ার শক্তি থাকে কম। এসব নবজাতকের মৃত্যুঝুঁকিও বেশি।

এই শিশুদের বাঁচানোর জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হাসপাতালগুলোতে ক্যাঙারু মাদার কেয়ার (কেএমসি) নামের সেবা চালু করতে চাইছে। এতে নবজাতককে বিশেষ ধরনের থলেতে পুরে মায়ের শরীরের সঙ্গে লেপ্টে রাখা হয়, যেন নবজাতক একই সঙ্গে উত্তাপ ও বুকের দুধ পায়। এখন পর্যন্ত মাত্র ১৪২টি কেন্দ্রে এটা চালু হয়েছে। সারা দেশে এর চার গুণের বেশি কেন্দ্র দরকার।

ইউনিসেফ প্রতিবছরের শুরুতে শিশুদের জন্ম উদ্‌যাপন করে। গত ৩১ ডিসেম্বর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বনেতা ও সদস্যদেশগুলোর প্রধানদের আহ্বান জানায় ২০২০ সালের নবজাতকদের বাঁচানোর জন্য প্রশিক্ষণ ও চিকিৎসা সরঞ্জামে বিনিয়োগ বাড়াতে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, নবজাতকের জীবন রক্ষায় কী করা দরকার, তা সবারই জানা। এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও ওষুধ সরবরাহের সিদ্ধান্ত আছে। এখন দরকার কড়া নজরদারি।