বাপ-দাদার পেশায় বাদ্যকরেরা

চামড়া দিয়ে বাদ্যযন্ত্র ছেয়ে বাজানোর উপযোগী করছেন ঝন্টু মনিদাস। গত শুক্রবার মির্জাপুরের ফতেপুর ইউনিয়নের বাদ্যকর পাড়ায়।  ছবি: প্রথম আলো
চামড়া দিয়ে বাদ্যযন্ত্র ছেয়ে বাজানোর উপযোগী করছেন ঝন্টু মনিদাস। গত শুক্রবার মির্জাপুরের ফতেপুর ইউনিয়নের বাদ্যকর পাড়ায়। ছবি: প্রথম আলো

টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের থলপাড়া গ্রামের বাদ্যকরপাড়া (মণিদাসপাড়া) এলাকার বাসিন্দা পরেশ বাদ্যকর। খালি গায়ে কাঠের টুলে বসে হুঁকায় স্বস্তির টান দিচ্ছেন। টান শেষে কুড়াল হাতে নিয়ে গাছের টুকরা থেকে ছাল ছাড়াচ্ছেন খোল বানানোর জন্য। একই সঙ্গে তাঁর ছেলেকে বাদ্যযন্ত্রের ফ্রেম বানাতে কৃত্রিম উপায়ে তৈরি কোন্দানির রশি টেনে সহায়তা করছেন।

পরেশ বাদ্যকর (৭২) বলেন, ‘হুঁকা টানি আর কাম করি। আমাগো বাবা-দাদারা কাম করছে। আমরাও করতাছি। ঢোল-খোল আর ডুগডুগি-তবলা যা–ই কন, বাপের পেশার মান আমরাই রাখছি। পরাই ২০০ বছর ধইরা চইল্যা আসা এই পেশাডা আমরাই ধইরা রাখছি।’

গতকাল শুক্রবার থলপাড়া গ্রামের বাদ্যকরপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, পরেশের মতো আরও অনেকে বাদ্যযন্ত্র তৈরির কাজে ব্যস্ত।

পার্শ্ববর্তী ফতেপুর গ্রামের বাদ্যকরপাড়ার ঝন্টু মণিদাস (৭০) বলেন, ‘আমাগো তাঐ ঠাকুরের (দাদার বাবা) আমল থিক্যা কাম চলতাছে। অহনো আছে। যত দিন পারি চালিয়া যামু।’

মির্জাপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে কুর্ণী-ফতেপুর সড়কের পাশে থাকা থলপাড়া ও ফতেপুর গ্রাম দুটিকে যুক্ত করেছে এই বাদ্যকরপাড়া। সেখানে প্রায় ১৫০টি দরিদ্র পরিবারের ৯০০ লোকের বাস। তাঁদের বেশির ভাগেরই পেশা অন্যের বাড়িতে কাজ করা। তবে তাঁদের পূর্বপুরুষের পেশা ছিল কাঠ কিংবা মাটি আর চামড়া দিয়ে ঢোল, খোল, তবলা আর ডুগডুগি বানানো। পাশাপাশি বিয়ে, দুর্গাপূজা, কীর্তন কিংবা হিন্দুদের নানা ধরনের অনুষ্ঠানে বাঁশি বাজানো।

বর্তমানে গ্রাম দুটির অনেকেই বিভিন্ন পেশা বেছে নিয়েছেন। তবে মতিলাল বাদ্যকর, গোপাল বাদ্যকর, পরেশ বাদ্যকর, শংকর বাদ্যকরসহ কমপক্ষে ৫০ জন পূর্বপুরুষের পেশা ধরে রেখেছেন। বছরের অন্য সময় তাঁরা নানা কাজ করলেও সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত বাদ্যযন্ত্র বানানোর কাজ করেন।

পরেশ বাদ্যকরের ছেলে শংকর দাস জানান, তাঁরা সাধারণত বড় আকারের ঢোল বা খোলের ফ্রেম বানান। এতে আম, শিমুল, কড়ই, নিম ও নারকেলগাছের কাঠ ব্যবহার করেন। নারকেলগাছের কাঠ দিয়ে দিনে ১০টি ফ্রেম বানাতে পারলেও অন্য গাছের কাঠে সর্বোচ্চ ৭টি ফ্রেম বানানো যায়। ২৪ ইঞ্চি উঁচু ও ৬০ ইঞ্চি ব্যাসার্ধের একটি খোল বানাতে ১ হাজার টাকা ব্যয় হয়। বিক্রি করতে পারেন ২ হাজার ৫০০ টাকায়।

কৃষ্ণ বাদ্যকর জানান, মাটি শুকিয়ে তৈরি করা ও কাঠের তৈরি বাদ্যযন্ত্রের ফ্রেম তাঁরা কেনেন। তাতে নানা ধরনের রং করে শুকিয়ে নিতে হয়। এরপর প্রক্রিয়াজাত গরুর চামড়া দিয়ে বাদ্যযন্ত্রের ফ্রেম ছেয়ে এর পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়া হয়। এক জোড়া তবলা চার থেকে ছয় হাজার আর প্রতিটি ঢোল কিংবা খোল পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকায় পাইকারি বিক্রি করেন। খুচরা মূল্য আরও বেশি।

মণীন্দ্র মণিদাস জানান, গরুর চামড়ার দাম কম হওয়াতে তাঁদের উপকার হয়েছে। গরুর প্রতিটি চামড়া আগে অনেক বেশি দামে কিনলেও এখন ৬০০-৭০০ টাকায় কেনেন। একটি চামড়া দিয়ে চার-ছয়টি ঢোল বানানো যায়।

গোপাল মণিদাসের তিন ছেলে বাদল মণিদাস, ফালু মণিদাস ও সুজন মণিদাস। তিনজনই বাদ্যযন্ত্র তৈরির কাজ করেন। সুজন মণিদাস বলেন, আগে তাঁরা ফ্রেম আর ডিজাইন করতে হাতে কোন্দানি (ডিজাইন) দিতেন। এখন মেশিনে দেন। এতে আগে যেখানে ১০টা কাজ করতেন, এখন ৩০টা কাজ করতে পারেন।

সুজনের বড় ভাই বাদল মণিদাস জানান, সিলেট, ঢাকা, রাজশাহী, মানিকগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ক্রেতারা বাদ্যযন্ত্র পাইকারি কিনে নিয়ে যান। অনেক সময় মুঠোফোনেও অর্ডার নিয়ে মাল সরবরাহ করেন তাঁরা।

ফালু মণিদাস বলেন, ঐতিহ্য ধরে রাখতে গিয়ে তাঁদের অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। আগের মতো মানুষ আর ডুগি-তবলা কিনতে চায় না। ইলেকট্রিক যন্ত্রের ভিড়ে মাটি আর কাঠের এসব জিনিস কেমন যেন কম কেনাবেচা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘সরকার যদি আমাদের আর্থিকভাবে সহায়তা করত, তাহলে আমরা আরও সুন্দর কাজ করতে পারতাম। মালের চাহিদাও বাড়ত।’

সুজনের স্ত্রী তুলসী রানী বলেন, তাঁরা স্বামী-শ্বশুর এই কাজ করেন। ভবিষ্যতে তাঁর সন্তানেরাও করবে। সন্তানেরা লেখাপড়া করছে। বড় হয়ে তারা অন্য কাজ পাইলেও তিনি চাইবেন তারা যাতে তাঁদের ঐতিহ্য ধরে রাখে।

বাদ্যযন্ত্র তৈরির ঐতিহ্য ধরে রাখার পাশাপাশি হুঁকা টানার ঐতিহ্যও ধরে রেখেছেন থলপাড়ার বাদ্যকরপাড়ার পরেশ বাদ্যকর। তিনি জানান, প্রায় ৫০ বছর ধরে তিনি হুঁকা টানছেন।