জামিন শুনানি আজ, হয়রানি-গ্রেপ্তার না করার নির্দেশ হাইকোর্টের

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র নাইমুল আবরারের মৃত্যুর ঘটনায় অবহেলার অভিযোগে করা মামলায় প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানসহ ছয়জনের জামিন আবেদনের ওপর আজ সোমবার শুনানির জন্য দিন ধার্য করেছেন হাইকোর্ট। শুনানি না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের হয়রানি ও গ্রেপ্তার না করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। 

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল রোববার শুনানির দিন ধার্য করে এ নির্দেশ দেন।

ওই মামলায় ১৬ জানুয়ারি ঢাকার অ্যাডিশনাল চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত প্রথম আলো সম্পাদকসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেন। মোহাম্মদপুর থানা-পুলিশ এ মামলায় আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পরপরই বাদীপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১০ জনের নামে পরোয়ানা জারির আদেশ দেওয়া হয়।

গতকাল রোববার হাইকোর্টে হাজির হয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে জামিনের আরজি জানান প্রথম আলো সম্পাদকসহ ছয়জন। বেলা সাড়ে তিনটায় আবেদনটি শুনানির জন্য ওঠে। অপর পাঁচজন হলেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও কিশোর আলো সম্পাদক আনিসুল হক, জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক মহিতুল আলম, প্রথম আলোর হেড অব ইভেন্ট অ্যান্ড অ্যাকটিভেশন কবির বকুল, নির্বাহী শাহপরান তুষার ও নির্বাহী শুভাশীষ প্রামাণিক। এ ছাড়া কিশোর আলোর অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ সরবরাহের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জসীম উদ্দিন, মোশাররফ হোসেন, সুজন ও কামরুল হাওলাদার জামিনের আবেদন করেননি।

প্রথম আলোর পক্ষে শুনানিতে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম আমীর-উল ইসলাম, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন এবং আইনজীবী সুমাইয়া আজিজ ও প্রশান্ত কর্মকার। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন।

শুনানিতে এম আমীর-উল ইসলাম বলেন, দেশের প্রধান দৈনিকের সম্পাদক মতিউর রহমান এখানে এসেছেন। তাদের সহযোগী প্রকাশনা কিশোর আলো সম্পাদকসহ সবাই আদালতে উপস্থিত আছেন। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে জামিনের আবেদন করা হয়েছে।
পরে আমীর-উল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আদালত প্রথমে বিকেলে শুনানির জন্য নির্ধারণ করেছিলেন। সময় কম, তাই আদালত আদেশ দিয়েছেন নট টু হ্যারাস, নট টু অ্যারেস্ট (গ্রেপ্তার ও হয়রানি না করতে)। সোমবার এটি প্রথম দিকেই থাকবে। আমরা আমাদের যুক্তি, প্রার্থনা আদালতে পেশ করব।’

নিম্ন আদালতে জামিন না চেয়ে সরাসরি উচ্চ আদালত কেন জামিন চাইতে এলেন—এমন প্রশ্নে আমীর-উল ইসলাম বলেন, ‘যে ধরনের অ্যাকশনস (পদক্ষেপ) নেওয়া হয়েছে, সে অ্যাকশনসটাকেই অযৌক্তিক মনে হয়েছে। সুতরাং হাইকোর্টে আসা ছাড়া অন্য কোথাও ইফেক্টিভ রেজাল্ট পাওয়া যাবে না। তা ছাড়া, যিনি ঘটনাস্থলেই ছিলেন না, যেখানে তার পিতা (নাইমুলের বাবা) ওসি সাহেবকে অনুরোধ করে চিঠি লিখেছেন যে তাঁর কোনো অভিযোগ নেই, এটা দুর্ঘটনা। ফলে এটাকে আমাদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রসিকিউশনস বলে মনে হয়েছে।’

এর আগে গত বৃহস্পতিবার ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। সেদিন প্রত্যেকের নামে আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কাগজ পাঠানো হয়। ওই দিন দুপুরে মোহাম্মাদপুর থানার পুলিশ প্রথম আলো সম্পাদকসহ ১০ জনের নামে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। এরপর বাদীপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ১০ জনের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেন। যাঁদের নামে পরোয়ানা দেওয়ার আদেশ হয়, তাঁরা হলেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক, কিশোর আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক মহিতুল আলম, প্রথম আলোর হেড অব ইভেন্ট অ্যান্ড অ্যাকটিভেশন কবির বকুল, নির্বাহী শাহ পরাণ তুষার ও নির্বাহী শুভাশীষ প্রামাণিক, ডেকোরেশন ও জেনারেটর সরবরাহকারী জসীম উদ্দিন, মোশাররফ হোসেন, সুজন ও কামরুল হাওলাদার।

গত ৬ নভেম্বর নাইমুল আবরারের বাবা মজিবুর রহমান বাদী হয়ে ঢাকার আদালতে মামলাটি করেন। আদালত সেদিন নালিশি মামলাটি আমলে নিয়ে মোহাম্মদপুর থানাকে তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন। মামলায় মজিবুর রহমান অভিযোগ করেছেন, ১ নভেম্বর তাঁর ছেলে নাইমুল আবরার রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজে কিশোরদের ম্যাগাজিন কিশোর আলোর বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যায়।

প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছেন দেশের ৪৭ জন বিশিষ্ট নাগরিক। বিশিষ্ট নাগরিকেরা বলেন, দেশে বাক্স্বাধীনতার ওপর একের পর এক যেসব আঘাত আসছে, তা থেকে মামলাটিকে পৃথক করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। তাঁরা এই মামলায় প্রথম আলো সম্পাদকসহ সব অভিযুক্ত ব্যক্তির পরিপূর্ণ আইনগত প্রতিকার ও সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার অবারিত রাখার দাবি জানান। একই সঙ্গে এ ধরনের মামলাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বাক্স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে রুদ্ধ করার কাজে ব্যবহার করার চেষ্টা থেকে সবাইকে বিরত থাকারও আহ্বান জানান। বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীরা হলেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মানবাধিকারকর্মী হামিদা হোসেন, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান, সুলতানা কামাল প্রমুখ।

গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির বিষয়ে বিবৃতি দিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারবিষয়ক সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। তারা বলেছে, প্রথম আলো সম্পাদকসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে আইনি কার্যক্রম যেন সঠিক পদ্ধতি মেনে চলে, সেটি নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের সরকারকে সম্ভাব্য সব সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিতে হবে।

প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির খবরটি বৃহস্পতিবার প্রকাশ করেছে বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যম। এএফপি, নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, বিবিসি বাংলা, আইএএনএস, ভয়েস অব আমেরিকাসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে খবরটি। এই পরোয়ানাকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে একটি ভয়ানক ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেছে ওয়াশিংটনভিত্তিক মার্কিন সংবাদমাধ্যম বেনার নিউজ।

আরও পড়ুন: