শিশুদের কলরবে মুখর মৌচাক

তাঁবুর সামনে খাবার খাচ্ছে কাব স্কাউটরা। গতকাল গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার মৌচাক স্কাউট প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে।  ছবি: প্রথম আলো
তাঁবুর সামনে খাবার খাচ্ছে কাব স্কাউটরা। গতকাল গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার মৌচাক স্কাউট প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। ছবি: প্রথম আলো

দুই দিন আগেও মৌচাকের শালবনে জনমানব ছিল না বললেই চলে। শালবনে তাঁবুগুলো পড়ে ছিল। গতকাল রোববার সকালে সেই চিত্র পাল্টে যায়। প্রায় ৬ হাজার শিশুশিক্ষার্থীর কলরবে মুখর হয়ে ওঠে মৌচাকের শালবন। এই কাব স্কাউটরা দেশের বিভিন্ন জেলার স্কুল, মাদ্রাসা ও মুক্ত স্কাউট দলের সদস্য।

গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার মৌচাক জাতীয় স্কাউট প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গতকাল ছয় দিনব্যাপী (১৯ থেকে ২৪ জানুয়ারি) নবম জাতীয় কাব ক্যাম্পুরি শুরু হয়। প্রতি চার বছর পরপর এই আয়োজন করা হয়। এখানে অংশগ্রহণকারীদের বয়স ৬ থেকে ১০ বছর। এবারের কাব ক্যাম্পুরির থিম ‘কাবিং করব, শান্তির বার্তা আনব’। আজ সোমবার বিকেলে কাব ক্যাম্পুরির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন রাষ্ট্রপতি ও চিফ স্কাউট মো. আবদুল হামিদ।

গতকাল সকালে মৌচাক জাতীয় স্কাউট প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মনযূর উল করীম অডিটরিয়ামে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে কালিয়াকৈর ও গাজীপুর প্রেসক্লাবের সাংবাদিকেরা উপস্থিত ছিলেন। আয়োজকদের পক্ষে ক্যাম্পুরি–সম্পর্কিত তথ্য প্রদান করেন ডেপুটি ক্যাম্পুরি চিফ সরোয়ার মোহাম্মদ শাহরিয়ার, ডেপুটি ক্যাম্পুরি চিফ মু. তৌহিদুল ইসলাম, কাজী নাজমুল হক, ফেরদৌস আহমেদ, আতিকুজ্জামান, সহকারী ক্যাম্পুরি চিফ মীর মোহাম্মদ ফারুক ও সালাহউদদীন আহমেদ।

গতকাল স্কাউট প্রশিক্ষণকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শিশুরা দলবেঁধে সেখানে অবস্থান করছে। নিজের মালপত্র নিজেরাই বহন করে নিজ নিজ তাঁবুতে যাচ্ছে তারা। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শিশুরা এলেও ক্যাম্পুরিতে পৌঁছামাত্র সবাই সবার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। আর শিক্ষককে কাজ করতে দেখে ছোট ছোট শিক্ষার্থীরাও কাজে নেমে পড়ছে।

সাভারের ইমানদিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তামান্না নুসরাত বলে, ‘স্কাউট প্রশিক্ষণকেন্দ্রের পরিবেশটা দেখে মনে হচ্ছে পুরোটাই আমার নিজের এলাকা। এখানে আমরা যে কদিন থাকব, একটি পরিবারের সদস্য হয়ে থাকব।’ একই স্কুলের শিক্ষার্থী নুসরাত আরা বলে, ‘স্কাউট সর্বদা ভালো মানুষ হতে শেখায়। আমরাও লেখাপড়া করে ভালো মানুষ হতে চাই।’

স্কাউট লিডার রোকসানা আক্তার বলেন, ‘এখানে আসার আগে ভাবছিলাম, শিশুদের কীভাবে সামাল দেব? কিন্তু এখন দেখছি, ওরা নিজেদের কাজ নিজেরাই করছে।’

স্কাউট কর্মকর্তারা জানান, কাব ক্যাম্পুরি হচ্ছে কাব স্কাউটদের বৃহত্তম মিলনমেলা। প্রতি চার বছর পরপর বাংলাদেশ স্কাউটস এই মিলনমেলার আয়োজন করে থাকে। অংশগ্রহণকারী সবাই তাঁবুতে বসবাস করে ক্যাম্পুরির কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করবে। সবার জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে রান্না করা মানসম্মত খাবার সরবরাহ করা হবে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আগামী প্রজন্মের কাছে পরিচিত করার জন্য ক্যাম্পুরির মূল অ্যারেনার নামকরণ করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ অ্যারেনা।

বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন এলাকাকে সবার কাছে পরিচিত করার জন্য পুরো ক্যাম্পকে চারটি ভিলেজ এবং আটটি সাবক্যাম্পে বিভক্ত করা হয়েছে। সুন্দরবন, কক্সবাজার, কুয়াকাটা ও শ্রীমঙ্গল নামে চারটি ভিলেজ করা হয়েছে। সেন্ট মার্টিন, জাফলং, রাতারগুল, বিছনাকান্দি, সাজেক ভ্যালি, সুসং দুর্গাপুর, নীলগিরি ও কাপ্তাই লেক নামে আটটি সাবক্যাম্প রয়েছে।

কাব স্কাউটদের কাছে এবারের জাতীয় কাব ক্যাম্পুরিকে আকর্ষণীয়, উপভোগ্য ও স্মরণীয় করে তোলার জন্য শিক্ষণীয়, আনন্দদায়ক, বৈচিত্র্যময় ও উদ্দীপনামূলক ক্যাম্পুরি কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়েছে। এই কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার মাধ্যমে একজন কাব স্কাউট নিজের প্রতিভা বিকাশের পাশাপাশি নিজের দক্ষতা সবার সামনে উপস্থাপনের সুযোগ পাবে।

প্রত্যেক কাব স্কাউট তার প্রতিভাকে ১২টি কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার মাধ্যমে উপস্থাপনের সুযোগ পাবে। কার্যক্রমকে ‘স্বপ্ন’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। ১২টি স্বপ্ন হলো—স্বপ্ন-১: অরুণিমা, স্বপ্ন-২: তাঁবু কলা, স্বপ্ন-৩: কাব কার্নিভ্যাল, স্বপ্ন-৪: ছুটির আনন্দ, স্বপ্ন-৫: কাব অভিযান, স্বপ্ন-৬: ফান ফ্যাক্টরি, স্বপ্ন-৭: অন্য রকম বিজ্ঞান, স্বপ্ন-৮: এসডিভি (সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট ভিলেজ), স্বপ্ন-৯: ফান অ্যান্ড গেম, স্বপ্ন-১০: বন্ধু গড়ি, স্বপ্ন-১১: জানা–অজানা ও স্বপ্ন-১২: ক্যাম্পফায়ার। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রাতঃকালীন কাজ, নামাজ বা প্রার্থনা শেষে প্রত্যেক কাব স্কাউটকে ক্যাম্পুরির সূচি অনুসরণ করে নির্ধারিত ‘স্বপ্ন’–এ সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে হবে। ১০টি স্টিকার লাভ করতে পারলে একজন কাব স্কাউটকে তার দক্ষতার স্বীকৃতি হিসেবে ‘ক্যাম্পুরি মেডেল’ দেওয়া হবে।

এ ছাড়া কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠানাদির মধ্যে রয়েছে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, মহা তাঁবু জলসা ও সমাপনী অনুষ্ঠান, ভিলেজভিত্তিক তাঁবু জলসা, টপ
অ্যাচিভার্স রিইউনিয়ন, অভিভাবক দিবস ও উডব্যাজ রিইউনিয়ন।

মৌচাক স্কাউট স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে স্থাপন করা হয়েছে এসডিভি। এই ভিলেজে এসডিজির ১৭টি লক্ষ্য সম্পর্কে সাধারণ ধারণা দেওয়াই এই স্বপ্নের উদ্দেশ্য। পাশাপাশি কাব স্কাউটরা এখান থেকে দেশের ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবেশ, জলবায়ু, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, তথ্যপ্রযুক্তি, মুক্তিযুদ্ধসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ধারণা পাবে। এই ভিলেজ সরকারি, বেসরকারি সংস্থা ও এনজিও প্রতিষ্ঠানের স্টলের সমন্বয়ে স্থাপিত হবে। নির্ধারিত বিষয়ের পাশাপাশি কাব স্কাউটদের নির্মল আনন্দ লাভের জন্য নাগরদোলা, পুতুলনাচ, বায়োস্কোপ, পিঠাপুলি ইত্যাদির স্টল থাকবে।

বাংলাদেশ স্কাউটের ডেপুটি ক্যাম্পুরি চিফ (প্রচার, প্রকাশনা ও ডকুমেন্টেশন) সরোয়ার মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, ‘আমরা আশা করছি, কাবিংয়ের মাধ্যমে আজকের শিশুরাই আগামী দিনে শান্তির বার্তা নিয়ে আসছে। এখানকার শিক্ষা কাজে লাগিয়ে শিশুরা এগিয়ে যাবে তাদের লক্ষ্যে।’