ইয়াবা কেনাবেচা এখন বাকিতে

ইয়াবা বড়ি। ফাইল ছবি
ইয়াবা বড়ি। ফাইল ছবি

মিয়ানমারে উৎপাদিত ইয়াবা এত দিন নগদ টাকায় কিনে বাংলাদেশে আনা হতো। খুচরা বাজারে বিক্রিও হতো নগদে। ইদানীং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের কারণে বিপাকে পড়েন দুই দেশের ইয়াবা কারবারিরা। কিছুটা হলেও ‘ব্যবসায়’ ধস নামে। ফলে বাজার চাঙা রাখতে বাকিতে ইয়াবা বিক্রি শুরু করেছেন মিয়ানমারের কারবারিরা। দেশের খুচরা বাজারেও এখন সেই হাওয়া—‘মাল বেচে দাম দাও’।

বাকিতে ইয়াবা আসায় নিষিদ্ধ এই মাদকের বাজার আবার জমজমাট হতে শুরু করেছে। তবে চেনা পথের বদলে ইয়াবা আসছে অচেনা নতুন পথ দিয়ে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলাম সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, নাফ নদী হয়ে ইয়াবা আসার পরিমাণ অনেকটা কমেছে। তবে মিয়ানমার সীমান্ত থেকে আরও উত্তর দিকে এবং বাংলাদেশ সীমান্তের দক্ষিণ দিক দিয়ে ইয়াবা ঢুকছে।

বিজিবি, পুলিশ, র‌্যাব, কোস্টগার্ড ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভিন্ন পথ দিয়ে আসা ইয়াবা টেকনাফ, উখিয়া ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ১৮টি পয়েন্ট দিয়ে ঢুকে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। মুসলিম রোহিঙ্গারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এগুলো বয়ে নিয়ে আসছে।

ধারাবাহিক ‘বন্দুকযুদ্ধ’ ও সাঁড়াশি অভিযানের মধ্যেই দেশে ইয়াবার আমদানি ও কেনাবেচা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০১৮ সালে বিভিন্ন সংস্থার অভিযানে ৫ কোটি ৩০ লাখ ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে। এত বিপুল পরিমাণ মাদক আগে কখনো উদ্ধার হয়নি।

জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ইউএনওডিসির মতে, যত মাদক বিক্রি হয় ধরা পড়ে তার মাত্র ১০ শতাংশ। সেই হিসাবে গত বছরে শুধু ইয়াবা বড়িই বিক্রি হয়েছে ৫৩ কোটির মতো। যার বাজারমূল্য প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা (প্রতি বড়ি দেড় শ টাকা)। হিসাব করে দেখা গেছে, মাদকের পেছনে বছরে মাদকসেবীরা প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা খরচ করছেন। দেশে ৬৬ থেকে ৭০ লাখ লোক মাদকাসক্ত বলে মনে করা হয়।

মাদকের ভয়াবহতা রোধে ২০১৮ সালের ৪ মে থেকে দেশব্যাপী অভিযান শুরু হয়। চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে গতকাল রোববার পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৪৮৫ জন। অভিযানের মুখে সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১০২ জন মাদক ব্যবসায়ী আত্মসমর্পণ করেন। কিন্তু এত কিছুর পরও মাদক কেনাবেচা বন্ধ হয়নি।

>

বাকিতে ইয়াবা বিক্রি মিয়ানমারের কারবারিদের
দেশের খুচরা বাজারেও এখন একই হাওয়া

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, কেনাবেচা একেবারে বন্ধ না হলেও কমে গেছে, মাদক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেও রয়েছে।

কক্সবাজারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জানিয়েছেন, চলতি জানুয়ারি মাসের প্রথম ১৯ দিনে কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ধার হয়েছে ৪ লাখ ৬১ হাজার ৫০০ ইয়াবা বড়ি। এ সময় ৯ রোহিঙ্গাসহ ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গত ডিসেম্বরে উদ্ধার করা হয় ২৭ লাখ ৩৫ হাজার ইয়াবা বড়ি। এ সময় ৪৫ রোহিঙ্গাসহ ৯৮ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগে নভেম্বরে জব্দ করা হয়েছে ৬ লাখ ৫৫ হাজার ১৪টি ইয়াবা।

ইয়াবা চোরাচালান বেড়ে যাওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন কক্সবাজার চেম্বারের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ইয়াবা ব্যবসায়ী আত্মসমর্পণের পর ধারণা করা হয়েছিল ইয়াবা ব্যবসা বন্ধ হবে। কিন্তু তা হয়নি, বরং তা বেড়ে গেছে। এখন বাকিতে ইয়াবা নিয়ে আসছে রোহিঙ্গারা।

টেকনাফ মডেল থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ বলেন, ইয়াবা ব্যবসা কমেছে, তবে নৌপথ নিয়ন্ত্রণ করা গেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতো। সেটা করা সম্ভব হচ্ছে না।

১৮ পয়েন্ট দিয়ে আসছে ইয়াবা

গত ১৩ ডিসেম্বর টেকনাফের রঙ্গিখালী সীমান্ত থেকে ৮ লাখ ১০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করে র‌্যাব। এ ঘটনায় চার ইয়াবা কারবারিকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরা সবাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত। এই চার ব্যবসায়ী হলেন নুর আমিন ওরফে নুর হাফেজ, ছৈয়দ আলম ওরফে কালু, ছৈয়দ নুর ও মোহাম্মদ সোহেল। তাঁদের সবার বাড়ি টেকনাফে। এদের কাছ থেকে ২টি পিস্তল, ৪টি ওয়ানশুটারগান ও ৭০ রাউন্ড গুলি জব্দ করা হয়।

জানতে চাইলে র‌্যাব-৭-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ মশিউর রহমান বলেন, এত তৎপরতার মধ্যেও বড় বড় চালান ঢুকছে। রোহিঙ্গাদের অনেকে এ কাজে জড়িয়ে পড়েছে। এদের সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে টেকনাফের সেন্ট মার্টিন, শাহপরীর দ্বীপ, দমদমিয়া, লেদা, রঙ্গিখালী, উলুচামারী, মৌলভীবাজার, নোয়াখালীয়াপাড়া, শাপলাপুর, সাতঘরিয়াপাড়া, উখিয়ার আমতলি, পালংখালী, মরিচ্যা, রেজুখাল, নাইক্ষ্যংছড়ির গর্জনবুনিয়া, তুমব্রুসহ অন্তত ১৮টি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ইয়াবা ঢুকছে। রোহিঙ্গা শিবির-সংশ্লিষ্ট এলাকা দিয়ে ইয়াবা আসছে বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন।

টেকনাফ-২ বিজিবি গত নভেম্বরে উদ্ধার করে ২ লাখ ৩৮ হাজার ৩২ ইয়াবা। গ্রেপ্তার করে ২৩ জনকে। কিন্তু গত ডিসেম্বর মাসে উদ্ধার করে ৮ লাখ ৫৫ হাজার ১১৭ ইয়াবা।

টেকনাফ ২ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ ফয়সাল হাসান খান প্রথম আলোকে বলেন, ইয়াবা পাচার কিছুতেই কমছে না।

বিজিবি ও র‌্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, হঠাৎ ইয়াবা পাচার বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ মিয়ানমারের ব্যবসায়ীদের বাকিতে ইয়াবা বিক্রি। রোহিঙ্গারা ইয়াবার চালান নিয়ে নতুন নতুন পয়েন্ট দিয়ে ভেতরে ঢুকছে।

গত ২১ ডিসেম্বর ভোররাতে উখিয়ার পালংখালী সীমান্তে বিজিবির সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ছিদ্দিক ও মো. শাহজাহান নামের দুই রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়। এ সময় ৪০ হাজার ইয়াবাসহ একটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে বিজিবি।

১০ ডিসেম্বর টেকনাফের হ্নীলা সীমান্তে বিজিবির সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ইমাম হোসেন (২৫) নামের আরেক রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়। এ সময় ১ লাখ ২০ হাজার ইয়াবাসহ একটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে বিজিবি।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন বলেন, ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর অনেকে জড়িত। সেখানকার ৩৭টি কারখানায় ইয়াবা তৈরি হচ্ছে। এখন ব্যবসা ধরে রাখতে তারা বাকিতে ইয়াবা দিচ্ছে। সেই ইয়াবার ঢল থামানো মোটেই সহজ কাজ নয়।

 জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক ও সরকারদলীয় সাংসদ নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, ইয়াবা পাচার যে কোনোভাবেই থামাতে হবে। এ জন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। ইয়াবা থামাতে না পারলে ভয়াবহ পরিণতি হবে, যার দায় কেউই এড়াতে পারবেন না।