প্রতিশ্রুতির দূষণে দূষিত এক নির্বাচন

প্লাস্টিকে মোড়া কোটি কোটি পোস্টারের ফল ঢাকার আরও দূষণ। ছবি: প্রথম আলো
প্লাস্টিকে মোড়া কোটি কোটি পোস্টারের ফল ঢাকার আরও দূষণ। ছবি: প্রথম আলো

উন্নয়নের প্রতিশ্রুতির দূষণে ছেয়ে গেছে ঢাকার অলিগলি, পথঘাট, পার্ক-খেলার মাঠ। এগিয়ে আসছে সিটি করপোরেশনের ভোট গ্রহণের দিন। চলতি পথে, রাস্তার দুধারে, মাথার ওপরে যেদিকেই তাকানো যায়, শুধু মিথ্যা প্রতিশ্রুতির নির্লজ্জ প্রদর্শনী! উন্নয়নের গল্প আর গান কানের পর্দা ছিঁড়েফুঁড়ে দিচ্ছে নগরবাসীর। নগরবাসী ঘরপোড়া গরু বৈ তো নয়। তাদের অভিজ্ঞতা বলে, এসব প্রতিশ্রুতির অধিকাংশই মিথ্যা। তারা জানে, ‘সে কহে বিস্তর মিছা যে কহে বিস্তর।’ সত্য এই যে, ঢাকার উন্নয়ন নিয়ে কেউ ভাবে না, কেউ ভাবে না ঢাকাবাসীর কল্যাণের কথা। ভাবলে উন্নয়নের দূষিত প্রতিশ্রুতির প্লাবনে আমরা ভাসতাম না। এরই মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নগরীর মুকুট নিয়ে বসে আছে ঢাকা। এতসব দূষণের সঙ্গে আবার সম্প্রতি যোগ হয়েছে মিথ্যা প্রতিশ্রুতির দূষণ। নগরবাসী এসব দেখেশুনে নির্বাক। এত দূষণের ভার তারা নেবে কীভাবে?

কাটা রাস্তা উদোম হয়ে পড়ে থাকে দিনের পর দিন। উদোম রাস্তার পাশে পথচারী বার্তা খুঁজে পায় ‘জরুরী উন্নয়ন কাজ চলিতেছে’। কিন্তু কার জন্য এই উন্নয়ন আয়োজন, আর কেনই বা কাজটি জরুরি হয়ে পড়ল, সেটি তাদের কাছে বোধগম্য নয়। সে শুধু জানে, কর্তৃপক্ষের অতি জরুরি প্রয়োজনের দাবিতে তার জরুরি প্রয়োজনটি গুরুত্ব হারাবে। সঠিক সময়ে সে তার গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে না। এই ‘জরুরী অবস্থার’ শেষ কবে, কীভাবে, সেটিও তার অজানা। বছরব্যাপী নানান উন্নয়নকাজ চলতেই থাকে; কিন্তু উন্নয়ন নামের সোনার হরিণের দেখা মেলে না, সেবার গুণগত মানেরও কোনো পরিবর্তন হয় না।

ইদানিং নগরবাসীর মাথায় ছায়া হয়ে আছে পলিথিনে মোড়ানো উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি সংবলিত মার্কা মারা পোস্টার। প্লাস্টিকে মোড়ানো নগরের ছাদ ভেদ করে মাঘের শীতও নগরে প্রবেশ করতে পারছে না। লেমিনেটিং কাগজে মোড়ানো ডিজিটাল পোস্টারের জয় হয়েছে, কিন্তু সুস্থ, সচল আর আধুনিক ঢাকা গড়ার স্বপ্ন নগরবাসীর অধরাই রয়ে যাচ্ছে। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ আর বিলুপ্তপ্রায় ঢাকার খালগুলো একরাশ ভয় নিয়ে নিরুপায় অপেক্ষায় আছে প্লাস্টিকে মোড়ানো লাখ লাখ পোস্টারের শেষ আশ্রয় হওয়ার জন্য। টন টন নতুন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি করছেন যাঁরা, তাঁরাই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন নগরকে দূষণমুক্ত করার।

গত বছর ঢাকাবাসী মোকাবিলা করেছে এক অভূতপূর্ব ডেঙ্গু পরিস্থিতি। গত বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা লাখ ছাড়ায়; যার ৫৬ শতাংশই ছিল ঢাকাবাসী। প্রায় তিন হাজার মানুষ মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। ডেঙ্গু জ্বর ঢাকা থেকে ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। ডেঙ্গুর মৌসুম শেষ হলেও এখনো থেমে নেই ডেঙ্গুর সংক্রমণ। প্রায় প্রতিদিনই ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছে হাসপাতালে। মশামুক্ত ঢাকা গড়ার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মশারা বীরদর্পে উড়ে বেড়াচ্ছে এই শীতের মৌসুমেও। ঢাকাবাসী এখনো প্রত্যক্ষ করেনি বিদেশ ভ্রমণের মাধ্যমে অর্জিত মশকনিধন জ্ঞানে সমৃদ্ধ বিশেষজ্ঞ দলের কারিশমা। পুরো ঢাকা শহরকে আলোঝলমলে শহর বানানোর প্রতিশ্রুতির আড়ালে অন্ধকারাচ্ছন্ন অলিগলিতে কিংবা রাজপথে চলছে ধর্ষণসহ নারীর প্রতি নানা যৌন নির্যাতন আর সহিংসতার ঘটনা। গণপরিবহনে ধর্ষণের মাত্রা রেকর্ড ছাড়িয়েছে। মিথ্যা জন্মনিবন্ধন সনদের সহজলভ্যতা শহরের বস্তিগুলোকে বাল্যবিবাহের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছে। ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের আশ্রয়দাতা জনপ্রতিনিধিদের উদারতায় আরও বাড়বে না তো ধর্ষণের তীব্রতা!

নগরবাসী আজ জানতে চায় ট্র্যাফিক জ্যাম, বায়ুদূষণ এবং পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে এবং প্রতিকারে, অগ্নিনির্বাপণ-ব্যবস্থার উন্নয়নে, নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ বিভিন্ন ইস্যুতে প্রার্থীদের কর্মপরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নের কৌশল। তারা আরও জানতে চায়, উন্নয়ন পরিকল্পনায় নগরবাসীর কোনো অংশীদারি কিংবা অংশগ্রহণের সুযোগ আছে কি না। তা যদি না হয়, তবে কী করে ঢাকা হয়ে উঠবে ‘সবার ঢাকা’? শুধু তা-ই নয়, নগরবাসী জানতে চায় নির্বাচনের প্রার্থীদের সিটি করপোরেশন, ওয়াসা, গ্যাস ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয়ের পরিকল্পনা। নগরের নারীদের দাবি, আগামীর ঢাকা হোক মানুষের ঢাকা; যে নগর পদে পদে নারীকে স্মরণ করিয়ে দেবে না যে মানুষ নয়, নারী। এই বিষয়গুলো সম্পর্কে নাগরিকের মনে আস্থা সৃষ্টি করা চা বানিয়ে কিংবা ক্রিকেট খেলে চটকদার প্রচারের ইস্যু সৃষ্টি করার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি। দিন দিন শ্রী হারাচ্ছে আমাদের প্রিয় ঢাকা। ঢাকাকে তাই বাঁচাতে হবে। কোনো মিথ্যা উন্নয়নের প্রতিশ্রুতির নতুন দূষণে ঢাকাকে আর দূষিত না করা হোক।

নিশাত সুলতানা: লেখক ও গবেষক
[email protected]