শিক্ষকদের ওপর যন্ত্রের চাপ

বিদ্যালয়ের জন্য ডিজিটাল হাজিরা যন্ত্র 

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

কেনা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন খুলনার রূপসা উপজেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। এশিয়া বিজ টেকনোলজি নামের একটি প্রতিষ্ঠান ওই যন্ত্র কিনতে চাপ দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

কয়েকজন শিক্ষক অভিযোগ করে বলেন, যে যন্ত্র দেওয়া হচ্ছে, তা নিম্নমানের। দামও নেওয়া হচ্ছে বেশি। যন্ত্রের ব্যাটারিতে চার্জ থাকছে না। এ ছাড়া প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে যেসব সুযোগ-সুবিধাসমৃদ্ধ যন্ত্র কেনার কথা বলা হয়েছে, ওই প্রতিষ্ঠান থেকে সরবরাহ করা হাজিরা যন্ত্রে তা নেই।

শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত জুন থেকে সব বিদ্যালয়ে হাজিরা যন্ত্র কেনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কোন মডেলের যন্ত্র কিনতে হবে, তা নিয়ে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও প্রধান শিক্ষকদের সমন্বয়ে একাধিক বৈঠক হয়। সর্বশেষ গত অক্টোবরে প্রধান শিক্ষকদের মাসিক বৈঠকে কেবি ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা হাজির হন। প্রতিষ্ঠানটি টিআইএমএমওয়াই ব্র্যান্ডের টিএম-৭০ (জিপিআরএস) মডেলের একটি যন্ত্র শিক্ষকদের সামনে উপস্থাপন করে। সেখানে প্রতিস্থাপনসহ যন্ত্রের দাম ধরা হয় ২৪ হাজার ৮৭৫ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে যন্ত্র কেনার জন্য যে পরিপত্র জারি করা হয়েছে, তার সঙ্গে এই যন্ত্রের মিল ছিল। এ বাবদ স্লিপের (স্কুল লেভেল ইমপ্রুভমেন্ট প্ল্যান) তহবিলের ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত কেটে রাখে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়। পরে এই টাকা সব স্কুলের নিজস্ব হিসাবে জমা করে দেওয়া হয়।

শিক্ষকদের অভিযোগ, ২৩ ডিসেম্বর মন্ত্রণালয় থেকে একটি পরিপত্র জারি করে স্লিপের টাকা থেকে যন্ত্র না কিনতে নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই হিসেবে সব শিক্ষক পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত যন্ত্র কেনা থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু সেদিনই এশিয়া বিজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান উপজেলার চারটি স্কুলে যন্ত্র স্থাপন করে যায়। জানুয়ারির প্রথম থেকে আরও কিছু স্কুলে যন্ত্র স্থাপনের চেষ্টা করে এই সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটি। যেসব স্কুলের প্রধান শিক্ষকেরা যন্ত্রটি স্থাপন করতে রাজি হচ্ছেন না, তাঁদের কাছে সেটি রেখে যাওয়া হচ্ছে। এশিয়া বিজের পক্ষ থেকে কেনা মেমো বা রসিদও দেওয়া হচ্ছে না।

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৬৮টি। প্রায় সব স্কুলেই হাজিরা যন্ত্র দেওয়া হয়েছে। উপজেলার কয়েকটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে যে হাজিরা যন্ত্র দেওয়া হয়েছে, তার মডেল টিএম-৫২। তবে ব্র্যান্ড একই আছে।

অভিযোগ উঠেছে, বাজারমূল্যের চেয়ে ডিজিটাল হাজিরা যন্ত্রটির দাম নেওয়া হচ্ছে বেশি। এসব যন্ত্রে চার্জও থাকছে না। খুলনা শহরের কয়েকটি দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, টিএম-৫২ মডেলের দাম সাড়ে ৯ হাজার টাকার কাছাকাছি। এর সঙ্গে প্রতিস্থাপনের খরচ যোগ হবে।

কয়েকটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন, কোনো বিদ্যালয়েরই নিজস্ব কোনো তহবিল নেই। হাজিরা যন্ত্র কিনতে হলে স্লিপ তহবিলের টাকা দিয়েই তা কিনতে হবে। সে ক্ষেত্রে নতুন যে যন্ত্রগুলো স্থাপন করা হচ্ছে, সেগুলোর টাকা তাঁরা কীভাবে মেটাবেন, তা জানেন না।

এ বিষয়ে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মুহা. আবুল কাশেম বলেন, বিদ্যালয়ের হাজিরা যন্ত্র কেনার ব্যাপারে শিক্ষকদের তাঁরা কোনো নির্দেশনা দেননি। ওই যন্ত্র কেনার কথা বিদ্যালয়ের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায়। বিদ্যালয়গুলো কী যন্ত্র কিনবে, তা তাদের নিজেদেরই দায়িত্ব। তবে সেলিম রেজা নামের কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা ওই যন্ত্র কেনার ব্যাপারে বারবার চাপ দিচ্ছেন।

স্লিপের টাকা থেকে যন্ত্র না কেনার নির্দেশনার ব্যাপারে জানতে চাইলে আবুল কাশেম বলেন, বিদ্যালয়ের হাজিরা যন্ত্র কেনার জন্য ২০১৮-১৯ অর্থবছরের স্লিপের টাকা রেখে দেওয়া হয়েছে। এখনকার টাকা দিয়ে কেউ যন্ত্র কিনতে পারবেন না।

১২ জানুয়ারি দুপুরে আবুল কাশেমের কার্যালয়ে কথা বলার সময় তাঁকে ফোন দেন সেলিম রেজা। তখন আবুল কাশেম তাঁকে জানান, ইতিমধ্যে যেসব বিদ্যালয়ে হাজিরা যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে, সেগুলোয় চার্জ থাকছে না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেলিম রেজা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসম্পাদক। বর্তমানে তিনি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের অর্থ ও পরিকল্পনাবিষয়ক উপকমিটির সদস্য। তাঁর বাড়ি খুলনার দিঘলিয়া উপজেলায়।

পরে মুঠোফোনে সেলিম রেজা প্রথম আলোকে বলেন, ওই যন্ত্র কেনার ব্যাপারে কাউকে চাপ দেওয়া হচ্ছে না। তিনি এশিয়া বিজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন। তবে তাঁর এক আত্মীয় এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন।

জানতে চাইলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এ এস এম সিরাজুদ্দোহা বলেন, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার পর কোনো বিদ্যালয়েই স্লিপের টাকা দিয়ে হাজিরা যন্ত্র কেনা যাবে না।