জসিমের মনে এখন স্বস্তি

পুলিশের খাতায় কোনো মামলা ছিল না। গ্রামের আর দশজনের মতো সাধারণ জীবন ছিল মধ্যবয়সী জসিম উদ্দিনের। স্ত্রী, সন্তান নিয়ে কেটে যাচ্ছিল দিন। কিন্তু একদিন সব তছনছ হয়ে যায়। শুধু নামের মিলের কারণে অপরাধ না করেও খেটে খাওয়া হাতে পড়ে হাতকড়া। গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। সংবাদের খোঁজে থাকা প্রথম আলো প্রতিবেদকের নজরে পড়ে বিষয়টি। ছাপা হয় জসিমকে নিয়ে প্রতিবেদন। অবশেষে মুক্তি পান। প্রমাণিত হয়, তিনি নির্দোষ।

এখন অটোরিকশা চালিয়ে স্ত্রী, চার ছেলেমেয়ে নিয়ে দিন কাটছে জসিমের। তাঁর বাড়ি চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলায়।

ঘটনার শুরু ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে। কারা ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, লোহাগাড়ার পারভীন আক্তার নামের এক নারী তাঁর স্বামী জসিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে যৌতুকের মামলা করেন। পরে আদালত বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন। পরের বছরের (২০১৪) ২৪ এপ্রিল জসিমের বিরুদ্ধে যৌতুকের জন্য নির্যাতনের সত্যতা পাওয়া গেছে মর্মে প্রতিবেদন দেওয়া হয়। আদালত আসামি আবুল কাশেমের ছেলে জসিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।

এই পরোয়ানামূলে লোহাগাড়া থানা-পুলিশ ওই বছরের ৩১ আগস্ট উপজেলার আবুল হোসেনের ছেলে জসিম উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠান। পরে আদালত তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

পরে এই প্রতিবেদক জানতে পারেন কারাগারে যাওয়া জসিম নিরপরাধ। আসল জসিমকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেনি। ২০১৪ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ‘পুলিশের ভুলে কারাবাস’ শিরোনামে প্রথম আলোর শেষ পৃষ্ঠায় জসিমের ছবিসহ প্রতিবেদন ছাপা হয়। ওই দিনই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক প্রকাশিত প্রতিবেদনের সত্যতা পেয়ে জসিমকে মুক্তির আদেশ দেন। আদালতে জসিম বলেন, ‘বউ–পোয়া ন খায় আছে। আরে ছাড়ি দ। আই হোসনর পোয়া, কাশেমের ন।’ আদেশ শোনার পর আসামির কাঠগড়ায় থাকা জসিম আনন্দে কান্নায় ভেঙে পড়েন।

>

নামের মিল থাকায় ভুলক্রমে কারাবাস করেন অটোরিকশাচালক জসিম উদ্দিন
প্রথম আলোতে প্রতিবেদন প্রকাশের পর মুক্ত হন তিনি

পরে আদালতে দেওয়া পুলিশের এক প্রতিবেদনে পুরো ঘটনাটির জন্য দুঃখ প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, নিরপরাধ জসিমকে ধরা তাদের ইচ্ছাকৃত ছিল না। এটা ছিল তাদের ভুল।

সম্প্রতি জসিমের অবস্থা দেখতে লোহাগাড়ার দরবেশ হাটে যান এই প্রতিবেদক। ভিটায় সেমিপাকা ঘর। পাশে ছোট পুকুর। উঠানে কথা হয় জসিমের সঙ্গে। সেদিনগুলোর কথা তুলতেই ঝরঝর করে নেমে আসে চোখের পানি। পানি মুছতে মুছতে বলেন, ‘এই কান্না আনন্দের, মুক্তির। সেদিন প্রথম আলোতে সংবাদ না হলে মুক্তি পেতাম না। সারা জীবন অপরাধী হয়েই থাকতাম। স্ত্রী, সন্তান, প্রতিবেশী সবাই জানত আমি অপরাধী। মিথ্যা এই অপবাদ থেকে প্রথম আলো আমাকে মুক্ত করেছে। আমি গরিব। কী আর করব। শুধু দোয়া করি, প্রথম আলোর জন্য।’

স্বাভাবিক জীবনে অটোরিকশাচালক জসিম উদ্দিন। ৭ জানুয়ারি চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার দরবেশ হাট এলাকায়।  ছবি: সৌরভ দাশ
স্বাভাবিক জীবনে অটোরিকশাচালক জসিম উদ্দিন। ৭ জানুয়ারি চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার দরবেশ হাট এলাকায়। ছবি: সৌরভ দাশ

জসিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘অপরাধীর মতো নয়, আমি বুক ফুলিয়ে হাঁটি। কারণ, আমি নিরপরাধ।’ কথাগুলো বলার সময় জসিমের চেহারায় ছিল স্বস্তির ছাপ।

জসিমের স্ত্রী নাসিমা আক্তার বলেন, ছেলেমেয়ে বড় হচ্ছে। আপনারা সত্যটি তুলে না ধরলে সারা জীবন এই কলঙ্ক বয়ে বেড়াতে হতো। স্বামী কারাগারে থাকলে সংসার তছনছ হয়ে যেত।

গ্রামের সবার মুখে মুখে এখনো জসিমের ওই ঘটনা। তাঁর চাচাতো ভাই প্রতিবেশী আবুল কালাম বলেন, ‘শুরুতে কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি আমরা। পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর সব খোলাসা হয়।’

যে মামলায় জসিম গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, সেই মামলার বিচার এখনো শেষ হয়নি। একমাত্র আসামি জামিনে গিয়ে পলাতক রয়েছেন বলে জানান বাদীর আইনজীবী আবু তাহের। নিরপরাধ জসিম কারাভোগ করায় তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন।

অপরাধী না হয়েও কারাভোগ করায় ক্ষতিপূরণ চেয়ে এত বছরেও মামলা কেন করেননি জানতে চাইলে জসিম বলেন, ‘আমি এসব নিয়ে আর ভাবছি না। কিডনি ও যকৃতের অসুখে ভুগছি। মামলা করে নতুন কোনো ঝামেলায় জড়াতে চাই না।’ গতকাল সোমবার ভোরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তিনি।