ধর্ষণ মামলার সাক্ষীকে বিপদে রেখে সটকে পড়ল পুলিশ

পাবনায় পুলিশ কর্মকর্তার সামনে ধর্ষণ মামলার সাক্ষীকে মারধর করার অভিযোগ উঠেছে। ছবি: সংগৃহীত
পাবনায় পুলিশ কর্মকর্তার সামনে ধর্ষণ মামলার সাক্ষীকে মারধর করার অভিযোগ উঠেছে। ছবি: সংগৃহীত

সন্ধ্যা ৬টা ৪৭ মিনিট। চায়ের দোকান থেকে সহকারীকে নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছেন পুলিশের এক কর্মকর্তা। ঠিক তাঁর পেছন পেছন সাত থেকে আটজনের একদল যুবক অপর এক যুবককে মারপিট করতে করতে বের হচ্ছেন। সবাই মিলে হাতুড়ি ও লোহার রড দিয়ে এলোপাতাড়ি পেটাচ্ছেন ওই যুবককে।

গত শুক্রবার হামলার এই ঘটনা ঘটেছে পাবনা জেলা সদরের গাছপাড়া মোড়ে। পরবর্তী সময়ে দোকানে থাকা সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় হয়।

মারধরের শিকার ওই যুবকের নাম আবদুল আলীম (৩৬)। তাঁর বাড়ি জেলা সদরের নূরপুর পাঁচপুকুর মহল্লায়। তাঁর দাবি, পুলিশের কাছে একটি ধর্ষণ মামলার সাক্ষ্য দিতে গিয়ে তিনি এই হামলার শিকার হয়েছেন। কিন্তু পুলিশ তাঁকে রক্ষা করেনি। গুরুতর আহত অবস্থায় আবদুল আলীমকে উদ্ধার করে পাবনা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে তাঁকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসা দিয়ে আবার তাঁকে পাবনা জেনারেল হাসপাতালে এনে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনায় আহতের স্ত্রী রুমা খাতুন বাদী হয়ে আটজনকে আসামি করে পাবনা সদর থানায় একটি মামলা করেছেন।

মামলার প্রধান আসামি আরিফুল ইসলাম। তিনি সদর উপজেলার মালিগাছা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলামের ভাই। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, আবদুল আলীম ঠিকাদারি ব্যবসা করেন। বেশ কিছুদিন ধরে আরিফুলের নেতৃত্বে স্থানীয় কয়েকজন যুবক তাঁর কাছে দুই লাখ টাকা চাঁদা দাবি করছিলেন। চাঁদার টাকা না দেওয়ায় কয়েকবার হুমকি দেয়। পরে এর জের ধরেই আরিফুলের নেতৃত্বে এই হামলা চালানো হয়।

হামলার ঘটনা দেখেও আবদুল আলীমকে রক্ষা না করার অভিযোগ উঠেছে পাবনা সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) খাইরুল ইসলামের বিরুদ্ধে। তিনি দাবি করেছেন, একজন সহকারীকে নিয়ে তিনি সাক্ষ্য নিতে গিয়েছিলেন। সেখানে একটি ঝামেলা হলে দ্রুত বের হয়ে এসে ফোর্স পাঠান। মারপিটের ঘটনাটি তাঁর সামনে হয়নি।

প্রত্যক্ষদর্শীদের কয়েকজন জানান, ঘটনার দিন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে পুলিশ কর্মকর্তা খাইরুল ইসলাম একজন সহকারীকে নিয়ে ওই চায়ের দোকানে যান। সেখানে তিনি একটি ধর্ষণ মামলায় চারজনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। এর মধ্যেই স্থানীয় কিছু যুবক এসে চায়ের দোকানে ভিড় জমান। ঝামেলার আঁচ পেয়ে পুলিশ কর্মকর্তা তাঁর সহকারীকে নিয়ে চায়ের দোকান থেকে বের হতেই সেখানে থাকা অন্য যুবকেরা আবদুল আলীমকে মারধর শুরু করেন। দোকান থেকে বের করে তাঁকে লোহার রড, হাতুড়ি ও চাপাতি দিয়ে আঘাত করতে থাকেন। পরে তাঁকে মাটিতে ফেলে রেখে পালিয়ে যান। স্থানীয় লোকজন ও স্বজনেরা এসে গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ডিসেম্বর মাসে ওই এলাকার এক কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়। গত ২২ ডিসেম্বর মেয়েটির বাবা বাদী হয়ে মালিগাছা ইউপির চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলামসহ আটজনকে আসামি করে সদর থানায় মামলা করেন। মামলাটির তদন্ত করছিলেন সদর থানার পরিদর্শক তদন্ত খাইরুল ইসলাম। তিনি এই মামলায় সাক্ষ্য নেওয়ার জন্য আহত আবদুল আলীমসহ চারজনকে ওই চায়ের দোকানে ডেকেছিলেন।

পাবনা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আবদুল আলীম অভিযোগ করে বলেন, ঘটনার দিন বিকেলে খাইরুল ইসলাম তাঁকে মুঠোফোনে ওই চায়ের দোকানে ডাকেন। তিনিসহ ছয়জন সেখানে সাক্ষ্য দিতে যান। পাঁচজনের নাম খাতায় লেখার পরই তাঁর ওপর আক্রমণ করা হয়। এ সময় পুলিশ কর্মকর্তা তাঁকে বাঁচানোর কোনো চেষ্টা না করেই ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। এরপর থেকে তিনি তাঁর কোনো খবর নেননি।

অভিযোগের বিষয়ে পাবনা সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) খাইরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি পাবনায় নতুন এসেছি। সাক্ষীদের ডেকে সাক্ষ্য নেওয়ার সময় উত্তেজনার আঁচ পাই। নিরস্ত্র ও ফোর্স সঙ্গে না থাকায় ঘটনাস্থল থেকে বের হয়ে এসে আশপাশে থাকা ফোর্সদের ঘটনাস্থলে আসতে বলি। এর মধ্যেই মারপিটের ঘটনাটি ঘটে। তবে ঘটনাটি আমার সামনে হয়নি।’

পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গৌতম কুমার বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ওই পুলিশ কর্মকর্তা ঘটনাস্থল থেকে বের হয়েই বিষয়টি থানায় জানান। খবর পেয়ে দ্রুতই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ পুলিশ ফোর্স সেখানে উপস্থিত হয়। পরে আহত আবদুল আলীমকে পুলিশি পাহারায় পাবনা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে ওই এলাকায় গোয়েন্দা পুলিশ পাঠিয়ে আসামিদের ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে আবদুল আলীম চিকিৎসার জন্য রাজশাহীতে থাকায় মামলা হতে একটু সময় লেগেছে। গতকাল সোমবার মামলা দায়েরের পরই দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদের ধরতে অভিযান অব্যাহত আছে।