ভোট এগিয়ে আসতেই উত্তেজনা বাড়ছে

ঢাকা সিটি
ঢাকা সিটি

নির্বাচন ঘনিয়ে আসতেই উত্তেজনা বাড়ছে মাঠে। প্রচারে বাধার পর এবার সরাসরি হামলার ঘটনা ঘটল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী তাবিথ আউয়ালের ওপর। মাথায় কিল, ঘুষি ও ঢিলের আঘাতে আহত হয়েছেন তিনি। গতকাল মঙ্গলবার মিরপুরের গাবতলী বাসস্ট্যান্ডের পেছনে বড় বাজার এলাকায় জনসংযোগের সময় এ হামলা হয়।

গতকালের ঘটনাসহ তাবিথ আউয়ালের নির্বাচনী প্রচারণায় তিনবার হামলার ঘটনা ঘটল। আর উত্তর সিটির বিভিন্ন ওয়ার্ডে হামলার ঘটনা ঘটেছে ১২টি। এর মধ্যে জনসংযোগের তৃতীয় দিনে ১২ জানুয়ারি প্রথম বাধার ঘটনা ঘটে মিরপুরের শাহ আলী এলাকায়। সেখানে তাবিথ আউয়াল জনসংযোগে গেলে স্থানীয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের একদল নেতা-কর্মী জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে বাধা দেন। একপর্যায়ে ইটপাটকেল ছুড়লে আল আমিন নামে বিএনপির এক কর্মী আহত হন। পরদিন ১৩ জানুয়ারি সন্ধ্যায় শাহজাদপুরে সুবাস্তু টাওয়ারের বিপরীতে একটি নির্বাচনী ক্যাম্প উদ্বোধন শেষে ফেরার সময় পেছন থেকে কর্মীদের ওপর হামলা হয়। দক্ষিণে বিএনপি-সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী ও তাঁদের সমর্থকদের ওপর এ পর্যন্ত হামলা হয়েছে আটটি।

ঢাকার দুই রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রচার শুরুর পর থেকে গতকাল পর্যন্ত ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের ৮৮টি অভিযোগ জমা পড়েছে। উত্তরে ২২ আর দক্ষিণে সিটিতে ৬৬টি অভিযোগ। রিটার্নিং কর্মকর্তাদের দাবি, প্রায় সব অভিযোগের নিষ্পত্তি তাঁরা করেছেন। কিন্তু বিএনপির মেয়র ও কাউন্সিলর পদপ্রার্থীরা বলছেন, কোনো অভিযোগই আমলে নিয়ে ব্যবস্থা না নেওয়ায় প্রতিদিন হামলা ও বাধা দেওয়ার ঘটনা বাড়ছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল বেলা পৌনে ১১টার দিকে গাবতলীর পর্বত সিনেমা হলের সামনে থেকে তাবিথ আউয়াল জনসংযোগ শুরু করেন। সেখান থেকে তিনি নেতা-কর্মীদের নিয়ে মিরপুরের কোটবাড়ি, বাজারপাড়া, হরিরামপুরের দিকে যাচ্ছিলেন। সোয়া ১১টার দিকে আনন্দনগর এলাকায় গেলে পেছন থেকে একদল দুর্বৃত্ত জনসংযোগকর্মীদের ওপর হামলা চালায়। মুহূর্তেই হুড়োহুড়ি শুরু হয়। এ সময় দুর্বৃত্তরা যাকে নাগালে পেয়েছে, তাকেই কিল, ঘুষি মেরেছে, লাঠি দিয়ে পিটিয়েছে। দুর্বৃত্তরা তাবিথ আউয়ালের ওপরও চড়াও হয়। এ সময় কর্মীরা তাঁকে ঘিরে রেখে রক্ষার চেষ্টা করেন।

>

এ পর্যন্ত দুই সিটিতে বিএনপির ওপর ২০টি হামলা। আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ ৮৮ টি।

হামলার মুখে তাবিথ আউয়াল, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা হাবিবুর রহমান, শহীদ উদ্দীন চৌধুরী, নাজিম উদ্দিন আলম এবং স্থানীয় কাউন্সিলর পদপ্রার্থী সাইদুল ইসলামসহ নেতা-কর্মীরা বড় বাজারে যান। সেখানে তাবিথ আউয়াল ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় আবারও হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। পুলিশ হামলাকারীদের সঙ্গে একই দিক থেকে দৌড়ে এসে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে। প্রায় ১৫ মিনিট ধরে জয় বাংলা স্লোগান ও মিছিল করে দুই দফায় হামলা হলেও পুলিশ কাউকে আটক করেনি। ঘটনার পুরোটা সময় ৯ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ-সমর্থিত কাউন্সিলর পদপ্রার্থী মুজিব সারোয়ার মাসুম (ঠেলাগাড়ি) ও তাঁর সমর্থকদের মারধরে অংশ নিতে দেখা যায়। এ পরিস্থিতিতে তাবিথ আউয়াল সেখান থেকে সরে গিয়ে গোলারটেক, দিয়াবাড়ি, বর্ধন বাড়ি, বাঘবাড়ি, গাবতলী বাসস্ট্যান্ড হয়ে ১১ নম্বর ওয়ার্ডের কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডে যান।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দারুস সালাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘এটা ঠিক হামলা না, জনসংযোগের সময় দুই পক্ষ মুখোমুখি হয়েছে আরকি। আমাদের পুলিশ দুই পক্ষকে দুই দিকে ডাইভারশন করে দিয়েছে। প্রার্থী আহত হওয়ার কোনো ঘটনা ঘটেনি।’

কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডে তাবিথ আউয়াল সাংবাদিকদের বলেন, ‘আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর পদপ্রার্থী মুজিব সরোয়ার মাসুমের নেতৃত্বে তাঁর গুন্ডাবাহিনী কাপুরুষের মতো পেছন থেকে হামলা করেছে। সবচেয়ে ভয়ংকর কথা হলো, এই হামলা কিছু পুলিশ কর্মকর্তার সামনেই হয়েছে। আমার সহকর্মী নেতা-কর্মীদেরও আঘাত করা হয়েছে।’

তাবিথ বলেন, এ ঘটনা পরিষ্কারভাবে প্রমাণ করে, ধানের শীষের পক্ষে জনগণ যে সাড়া দিচ্ছে, সে সাড়া থেকে যে গণ-অভ্যুত্থানের সৃষ্টি করছে, সে ভয় থেকেই এ হামলা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছি, তবে আমি শক্ত আছি, আমার মনোবল শক্ত আছে। কারণ, আমার প্রধান শক্তি হলো জনগণ।’

হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে মুজিব সারোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কথা ছিল তারা (বিএনপি) পর্বত সিনেমা হলের সামনে পথসভা করবে। আমি জনসংযোগ করছিলাম সেখান থেকে প্রায় এক কিলোমিটার ভেতরে বড় বাজারের উত্তরপাড়ায়। সেখানে এসে যদি বাইরের লোক আমার পোস্টার ছিঁড়ে, অশ্লীল স্লোগান দেয়, এটা তো কেউ সহ্য করবে না। এটা তো গ্রামভিত্তিক শহর।’

এ ঘটনায় গতকাল সন্ধ্যায় রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন তাবিথ আউয়াল। তাতে তিনি উল্লেখ করেন, তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে এই হামলা চালানো হয়েছে। পুলিশ আইনানুযায়ী সক্রিয় থাকলে এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার জন্য তিনি দারুস সালাম থানার ওসিকে সাময়িক বরখাস্তের দাবি জানান।

এরপর ১৬ নম্বর ওয়ার্ড ইব্রাহিমপুর এলাকায় প্রচারণা চালান তাবিথ। এতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ, যুবদলের সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন অংশ নেন। তাঁরা কচুক্ষেতের স্বাধীনতা চত্বরে পথসভা করেন। সেখানে কাউন্সিলর পদপ্রার্থী হাবিবুর রহমানের (ঘুড়ি প্রতীক) জন্য তাঁরা ভোট চান।

তাবিথ আউয়ালের ওপর হামলার বিষয়ে গতকাল দুপুরে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘তাঁর ওপর হামলার বিষয়ে এখনো শুনিনি। এর আগেও তারা নিজেরা নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ করেছিল। এবারও নিজেরা সংঘর্ষ বাধাতে পারেন।’

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এই হামলা পূর্বপরিকল্পিত ও কাপুরুষোচিত। নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, শাসকগোষ্ঠীর সন্ত্রাসী বাহিনী ততই বেপরোয়া হয়ে উঠছে।

তদন্তের নির্দেশ ইসির

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল গতকাল দুপুরে নির্বাচন কমিশনে গিয়ে তাবিথ আউয়ালের ওপর হামলা এবং তাঁর প্রচারে বাধা দেওয়ার বিষয়টি জানায়। বিকেলে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, তাবিথের ওপর হামলার বিষয়ে কমিশনের কাছে বিএনপি তাৎক্ষণিকভাবে অভিযোগ করেছে। কমিশন সেটি শুনেছে এবং সঙ্গে সঙ্গে রিটার্নিং কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

অবশ্য ঢাকা উত্তরের রিটার্নিং কর্মকর্তা আবুল কাশেম জানান, তিনি কোনো অভিযোগ পাননি। গতকাল রাত আটটার দিকে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনা সকালের, অথচ এখন পর্যন্ত তারা অভিযোগ পৌঁছাতে পারল না, এটা আমার খুব কষ্ট লাগে।’

ঢাকা দক্ষিণের রিটার্নিং কর্মকর্তা আবদুল বাতেন ৬৬টি অভিযোগের অধিকাংশই নিষ্পত্তির দাবি করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘৬৬টি অভিযোগ পেয়েছি। সব কটির বিষয়ে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। আমরা কাউকে সতর্ক করেছি, কাউকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছি, কিছু অভিযোগ প্রক্রিয়াধীন আছে।’

উত্তরে হামলা-বাধার ঘটনা বেশি

নির্বাচনী কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, মেয়রের পাশাপাশি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি-সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের প্রচারে হামলার ঘটনা অনেক। এ পর্যন্ত অন্তত ১২টি জায়গায় প্রার্থীদের ওপর হামলা বা তাঁদের প্রচার মাইক কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে গত শনিবার বিকেলে লালমাটিয়ায় ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী আতিকুল ইসলামের (ব্যাডমিন্টন প্রতীক) প্রচার মাইকসহ রিকশা নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। এ সময় রিকশাচালককে মারধর করা হয়।

আগের দিন শুক্রবার রাতে পোস্টার লাগানোর সময় হামলায় ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপির প্রার্থী শরিফউদ্দিন জুয়েলের চারজন কর্মী আহত হন। শুক্রবার পশ্চিম রাজাবাজার ঢালীবাড়ি পানির পাম্পের পাশে চা–দোকানের সামনে বিএনপির প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামানের সমর্থক আবুল বাশারকে মারধর করে আওয়ামী লীগের লোকজন। সন্ধ্যায় ইন্দিরা রোডে মারধরের শিকার হন মো. সবুজ। ওই দিন ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণখান বাজারে বিএনপির প্রার্থী আলী আকবরের (টিফিন ক্যারিয়ার) নির্বাচনী কার্যালয় ভাঙচুর করেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ টি এম মাসুদুজ্জামানের (মিঠু) কর্মীরা। দুপুরে ১০ নম্বর ওয়ার্ডের বেলতলা বস্তি এলাকায় বিএনপি-সমর্থিত কাউন্সিলর পদপ্রার্থী মাসুদ খানের (ঠেলাগাড়ি) জনসংযোগে হামলায় তিনজন আহত হন।