সড়ক দুর্ঘটনাটা ফাঁদা গল্প, আসল কাহিনি অপহরণ

স্কুলে যেতে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল মদিনাতুল কিবরিয়া জেরিন। পরে খবর আসে, অটোরিকশা থেকে পড়ে গুরুতর আহত হয়েছে। হাসপাতালে এক দিন পর মারা যায়। পরিবারও মেনে নিয়েছিল, জেরিন নিছক সড়ক দুর্ঘটনাতেই মারা গেছে।

তবে অটোরিকশাটির খোঁজ করতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে আসল কাহিনি। জেরিনকে অপহরণের চেষ্টা করছিলেন তিন তরুণ। তাঁদের হাত থেকে রেহাই পেতে চলন্ত অটোরিকশা থেকে ঝাঁপ দেয় সে। এ ঘটনা ধামাচাপা দিতে ওই তরুণেরা সড়ক দুর্ঘটনার গল্প ফাঁদেন। ঘটনার মূল সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ গতকাল মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন করে এসব কথা বলেছে। এরপর পরিবার তিনজনের নামে হত্যা মামলা করেছে।

মদিনাতুল কিবরিয়া জেরিন হবিগঞ্জ সদর উপজেলার ধল গ্রামের আবদুল হাইয়ের মেয়ে। সে স্থানীয় রিচি উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের কথা ছিল মেয়েটির। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া জাকির হোসেনও (২৫) ধল গ্রামের বাসিন্দা। তিনি গতকাল বিকেলে হবিগঞ্জ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

গতকাল সন্ধ্যায় হবিগঞ্জ পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়। এতে বক্তব্য দেন পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা। তিনি বলেন, জেরিন গত শনিবার সকাল নয়টায় স্কুলের উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হয়। অটোরিকশা থেকে নামতে গিয়ে অপর একটি অটোরিকশার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে সে গুরুতর আহত হয়, এমনটি প্রচার করা হয় আসামিদের পক্ষ থেকে। পরিবারের লোকজনও তা বিশ্বাস করে নেন। হাসপাতালে তার মৃত্যু হলে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ দাফন করেন তাঁরা। তবে জেরিনের সহপাঠীরা এবং এলাকার লোকজন ঘটনায় জড়িত অটোরিকশাচালকের শাস্তির দাবিতে আন্দোলনে নামেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনাটি তদন্ত করতে গিয়েই পুলিশ জানতে পারে আসল কাহিনি।

জাকির হোসেনের জবানবন্দির বরাত দিয়ে পুলিশ বলছে, তদন্তে তারা প্রথমে অটোরিকশাটি শনাক্ত করার ওপর জোর দেয়। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে আশপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে। তাঁদের কয়েকজন অটোরিকশাটির বিষয়ে বিবরণ দেন। বলেন, অটোরিকশার গায়ে ‘রিয়াদ পরিবহন’ লেখা ছিল। পরে পুলিশ অটোরিকশা সমিতির সহযোগিতা নেয়। জানতে পারে, রিয়াদ পরিবহন নামের অটোরিকশাটির চালক নুরে আলম ঘটনার পর থেকে পলাতক রয়েছেন। তবে তাঁর বাড়ি থেকে পুলিশ অটোরিকশাটি উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। পাশাপাশি নুরে আলমের মুঠোফোনের কল তালিকা যাচাই করা হয়। তাতে দেখা যায়, জাকির ও নুরে আলম ঘটনার দিন একাধিকবার ফোনে কথা বলেছেন। এরপর জাকিরকে সোমবার রাতে গ্রেপ্তারের পরই সব রহস্যের জট খুলে যায়।

পুলিশ সুপার বলেন, পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জাকির পুরো ঘটনার দায় স্বীকার করে নেন। এরপর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে রাজি হন। এরপর গতকাল বিকেলে তাঁকে আদালতে হাজির করা হয়। জাকিরের বর্ণনা অনুযায়ী তিনি জেরিনকে পছন্দ করতেন। এক মাস আগে তিনি মেয়েটিকে প্রেমের প্রস্তাব দেন। সে তাতে রাজি হয়নি। উল্টো নিজের পরিবারকে বিষয়টি জানিয়ে দেয়। এরপর মেয়েটির পরিবার জাকিরের পরিবারের কাছে অভিযোগ করে। এতে জাকির ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। পরিকল্পনা করেন জেরিনকে অপহরণের।

জাকির পার্শ্ববর্তী পাটনি গ্রামের অটোরিকশাচালক নুরে আলমের সহযোগিতা চান। তাঁদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যুক্ত হন হৃদয় নামে জাকিরের এক বন্ধুও। তাঁর বাড়িও পাটনি গ্রামে। সবাই জানতেন, সকাল নয়টার দিকে জেরিন স্কুলে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়। তার আগেই তার বাড়ি বরাবর গ্রামের প্রধান সড়কে অটোরিকশা দাঁড় করিয়ে রাখেন নুরে আলম। রাস্তায় এসে সেটি খালি দেখে উঠে বসে জেরিন। চলতে থাকে স্কুলের পথে। তবে কিছুক্ষণ পরেই ওই অটোরিকশায় ওঠেন হৃদয়। ধল থেকে ছেড়ে আসার পর পথ থেকে ওই অটোরিকশায় ওঠেন জাকিরও। তাঁকে উঠতে দেখেই মেয়েটি ভয় পায়। চালক নুরে আলম আরও দ্রুত অটোরিকশা চালাতে শুরু করেন। তাঁদের উদ্দেশ্য খারাপ বুঝতে পারে জেরিন। সে চলন্ত অটোরিকশা থেকে ঝাঁপ দিলে গুরুতর আহত হয়। তখন নুরে আলম অটোরিকশাটি থামিয়ে দেন। সবাই মিলে প্রচার করতে থাকেন, জেরিন অটোরিকশা থেকে নামছিল। এ সময় অপর একটি অটোরিকশা তাকে চাপা দিয়ে পালিয়েছে। এত নিখুঁতভাবে তাঁরা ঘটনাটি প্রচার করেন যে সবাই তা বিশ্বাস করেন।

গুরুতর আহত অবস্থায় জেরিনকে ওই দিন সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত রোববার তার মৃত্যু হয়। পরে মেয়েটির পরিবারের সদস্যরা ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশটি বাড়িতে এনে দাফন করেন। কবর থেকে লাশ উত্তোলন করে ময়নাতদন্ত করার জন্য আদালতে আবেদন করা হয়েছে জানিয়ে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা বলেন, আদালতের অনুমোদন মিললেই লাশ উত্তোলনের ব্যবস্থা করা হবে। আর মেয়েটির বাবা আবদুল হাই হবিগঞ্জ সদর থানায় হত্যা মামলা করেছেন। এতে জাকিরের পাশাপাশি তাঁর বন্ধু হৃদয় ও অটোরিকশাচালক নুরে আলমকে আসামি করা হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে হবিগঞ্জ সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রবিউল ইসলাম, হবিগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাসুক আলী, পরিদর্শক ফেরদৌস মোহাম্মদসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।