ঢাকায় কাউন্সিলর প্রার্থীদের বেশির ভাগই ব্যবসায়ী ও স্বশিক্ষিত

ঢাকা সিটি
ঢাকা সিটি

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সাধারণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের ৮৬ ভাগেরই পেশা ব্যবসা। অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন থেকে শুরু করে পিএইচডি ডিগ্রিধারীও লড়ছেন কাউন্সিলর পদে। তবে প্রার্থীদের বড় অংশেরই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বহর কম। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ প্রার্থী স্বশিক্ষিত ও স্বাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন।

সাধারণ ওয়ার্ডের মতো সংরক্ষিত ওয়ার্ডে নারী কাউন্সিলর প্রার্থীদেরও প্রায় এক-তৃতীয়াংশ স্বশিক্ষিত ও স্বাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন। নারী কাউন্সিলর প্রার্থীদের প্রায় অর্ধেক পেশায় গৃহিণী। তবে ব্যবসায়ীর সংখ্যাও কম নয়; এক-তৃতীয়াংশের কিছু বেশি ব্যবসায় যুক্ত।

সিটি করপোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) প্রার্থীদের জমা দেওয়া হলফনামার তথ্য বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া গেছে।

উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে মোট সাধারণ ওয়ার্ড ১২৯টি। ইসির তথ্য অনুযায়ী, এসব ওয়ার্ডে এখন কাউন্সিলর পদে লড়ছেন ৫৭৪ জন (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী দুজন ছাড়া)। তাঁদের মধ্যে ৫৩৯ জন প্রার্থী হলফনামায় নিজের পেশা উল্লেখ করেছেন।

হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সাধারণ ওয়ার্ডের ৪৬৬ জন নিজেদের পেশা লিখেছেন ব্যবসা।অর্থাৎ প্রার্থীদের ৮৬ দশমিক ৪৫ শতাংশই ব্যবসায়ী। আর দুই সিটিতে মোট ৫৫৫ জন প্রার্থী হলফনামায় তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা উল্লেখ করেছেন। তাঁদের মধ্যে স্বশিক্ষিত ও স্বাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন ১৭৯ জন (৩২.২৫ শতাংশ)। উচ্চশিক্ষিত প্রার্থীও কম নয়। দুই সিটিতে ১২০ জন (২১.৬২ শতাংশ) প্রার্থী স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পাস। বাকিরা পঞ্চম শ্রেণি থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন।

নির্বাচনে প্রার্থী হতে শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তবে আধুনিক নগর ব্যবস্থাপনায় কাউন্সিলরদের শিক্ষাগত যোগ্যতা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন স্থানীয় সরকারবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষাগত যোগ্যতা একটা গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি। কারণ নগর হচ্ছে আধুনিক জীবনযাপনের কেন্দ্র। যাঁরা কাউন্সিলর হবেন, তাঁদের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা প্রয়োজন। ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয় না।

ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য

স্থানীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে জাতীয় নির্বাচন সবখানে ব্যবসায়ীদের আধিপত্য। একাদশ সংসদ নির্বাচনের চেয়েও ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে ব্যবসায়ী প্রার্থী বেশি। একাদশ সংসদ নির্বাচনে ১ হাজার ৮৬৫ প্রার্থীর মধ্যে ব্যবসায়ী ছিলেন ৫৩ দশমিক ১ শতাংশ। আর ঢাকার দুই সিটিতে কাউন্সিলর পদে ব্যবসায়ী প্রার্থী ৮৬ দশমিক ৪৫ শতাংশ।

অধ্যাপক তোফায়েল আহমদ বলেন, সব ব্যবসায়ী খারাপ নন। তবে অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছেন, অনেকে ব্যবসার পুঁজি হিসেবে কাউন্সিলর হতে চান, নেতৃত্বে আসতে চান। নির্বাচিত হয়ে নিজের ব্যবসার সমৃদ্ধির জন্য কাজ করেন। এটি প্রধান হয়ে গেলে জনসেবা গৌণ হয়ে যায়।

হলফনামায় দক্ষিণ সিটির ২৫৮ জন এবং উত্তর সিটির ২০৮ জনের পেশা ব্যবসা লিখেছেন। আছেন আইনজীবী, কৃষক, রাজনীতিক, সমাজসেবক, শিক্ষক, সাংবাদিক, সংগীতশিল্পী, ছাত্র, চিকিৎসক, পরামর্শক ও গাড়ির চালকও। ‘বাড়িভাড়া’কে পেশা দেখিয়েছেন দুই সিটির ১৪ জন।

দক্ষিণে তিনজন পেশা উল্লেখ করেছেন রাজনীতি। উত্তরে এমন কেউ নেই। দক্ষিণে চাকরিজীবী ১৭ জন, আইনজীবী ৫ জন ও কৃষিকে পেশা হিসেবে উল্লেখ করেছেন দুজন। উত্তরে চাকরিজীবী ১৫ জন, আইনজীবী দুজন ও কৃষি পেশায় আছেন একজন।

শিক্ষার দৌড়

সাধারণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থীদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ স্বশিক্ষিত ও স্বাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন হলেও পাস করা চিকিৎসক ও পিএইচডি ডিগ্রিধারী প্রার্থীও আছেন। দুই সিটিতে এমন প্রার্থী তিনজন।

এমবিবিএস পাস করা প্রার্থীদের একজন আবদুল মতিন। তিনি উত্তর সিটির ৪১ নম্বর ওয়ার্ডে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আবদুল মতিন প্রথম আলোকে বলেন, সিলেট মেডিকেল কলেজ থেকে তিনি এমবিবিএস পাস করেছেন। তিনি ৪১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাতারকুল ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। তাঁর মতে, জনপ্রতিনিধি হওয়ার ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। তবে এর সঙ্গে সেবার মানসিকতাও থাকতে হবে।

দক্ষিণ সিটির ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ–সমর্থিত প্রার্থী ওমর-বিন-আব্দাল আজিজ হলফনামায় শিক্ষাগত যোগ্যতার জায়গায় লিখেছেন ‘ডক্টরেট’ ডিগ্রি। তিনি এর আগে ২০১৫ সালের নির্বাচনেও একই ওয়ার্ড থেকে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন।

দক্ষিণ সিটির প্রার্থীদের মধ্যে ৪ জন পঞ্চম শ্রেণি, দুজন সপ্তম, ৩৫ জন অষ্টম ও ৫ জন নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। এসএসসি ও এইচএসসি পাস যথাক্রমে ৫৭ ও ৪৭ জন। স্নাতক ৪৬ জন ও স্নাতকোত্তর পাস ২০ জন প্রার্থী।

উত্তরের প্রার্থীদের মধ্যে দুজন পঞ্চম শ্রেণি, ২৭ জন অষ্টম ও দুজন নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। এসএসসি ৩৬ ও এইচএসসি পাস ৩৭ জন। স্নাতক ৩০ জন এবং স্নাতকোত্তর পাস ২২ জন।

নারী কাউন্সিলর

দুই সিটিতে সংরক্ষিত ওয়ার্ড ৪৩টি। এর মধ্যে দুটিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়ে গেছে। বাকি ৪১টি ওয়ার্ডে ১৫৭ জন নারী কাউন্সিলর পদপ্রার্থী রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৫১ জন (৩২.৪৮ শতাংশ) স্বাক্ষরজ্ঞান ও স্বশিক্ষিত। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস ৩৬ জন (২২ দশমিক ৯৩ শতাংশ)। এইচএসসি ১৮ জন ও এসএসসি পাস ২৬ জন এবং ৮ম শ্রেণি পাস আছেন ২৩ জন।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার মতে, শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকলে ভালো। তবে না থাকাটা অযোগ্যতা নয়।

১৫৭ নারী প্রার্থীর মধ্যে দুজনের পেশা হলফনামায় উল্লেখ করা হয়নি। বাকি ১৫৫ জনের মধ্যে ৫৭ জন ব্যবসায়ী। ৭০ জন পেশায় গৃহিণী। এ ছাড়া ছয়জন আইনজীবী, চারজন শিক্ষক, চারজন চাকরিজীবী এবং ১০ জন রাজনীতি ও সমাজসেবার সঙ্গে জড়িত বলে হলফনামায় উল্লেখ করেছেন।

কাউন্সিলর পদে ব্যবসায়ীদের আধিক্যের বিষয়ে সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, রাজনীতি পুরোপুরি ব্যবসায়ীদের করায়ত্তে চলে গেছে। এটা এখন একটি ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে, এর প্রতিফলন এই নির্বাচনেও দেখা যাচ্ছে। কাউন্সিলর হয়ে অনেকে এ পদকে নানা ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড এবং চাঁদাবাজিতেও ব্যবহার করেন। এতে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান দুর্বৃত্তায়িত হয়, জনকল্যাণ হয় না।