ছয় বছর পর খোলা আকাশ দেখলেন তিনি

দীর্ঘ ছয় বছর পর কারাগারের নিরাপত্তা হেফাজত থেকে মুক্তি পেয়েছেন শ্রীধাম সাহা। ছবি: প্রথম আলো
দীর্ঘ ছয় বছর পর কারাগারের নিরাপত্তা হেফাজত থেকে মুক্তি পেয়েছেন শ্রীধাম সাহা। ছবি: প্রথম আলো

ফরিদপুর শহরের এক নম্বর গোয়ালচামট সড়ক এলাকার বাসিন্দা শ্রীধাম সাহা (৩০)। তাঁর নামে কোনো মামলা নেই। কিন্তু তারপরও ছয় বছরের বেশি সময় ধরে কারাগারের নিরাপত্তা হেফাজতে (সেফ কাস্টডি) আটক ছিলেন। অবশেষে বন্দিজীবন থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন তিনি।

শ্রীধামের বন্দিজীবনের শুরু ছয় বছর দুই মাস আগে। ২০১৩ সালের ২৯ নভেম্বর শ্রীধামের মা টুকটুকি সাহা (৪৯) ফরিদপুর কোতোয়ালি থানায় ছেলের বিরুদ্ধে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। সেখানে টুকটুকি সাহা অভিযোগ করেন, তাঁর স্বামী মারা গেছেন। শ্রীধাম মাদকাসক্ত। পৈতৃক সূত্রে সম্পত্তির মালিক হয়ে তিনি সংসারের নানা জিনিস বিক্রি করে নেশার টাকা জোগাড় করেন। ভবিষ্যতে নেশার টাকার জন্য স্থাবর সম্পত্তিও বিক্রি করে দিতে পারেন। এ কারণে শ্রীধামকে কারাগারের নিরাপত্তা হেফাজতে রাখার ব্যবস্থা করা হোক।

এরপর ২০১৩ সালের ৩০ নভেম্বর শ্রীধামকে জেলা কারাগারে পাঠিয়ে দেন আদালত। যেহেতু তিনি কোনো মামলার আসামি নন, তাই তাঁকে কখনো আদালতেও যেতে হয়নি। এ কারণে দীর্ঘ ছয় বছরে একবারের জন্যও কারাগার থেকে বের হওয়া হয়নি তাঁর। শ্রীধামের মাও ছেলেকে মুক্ত করার কোনো উদ্যোগ নেননি।

২০১৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকে কারাগারে কাজ করা শুরু করেন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ফরিদপুর ইউনিটের প্যারালিগ্যালরা। ওই বছরের ১ এপ্রিল কারাগারে শ্রীধামের সঙ্গে দেখা করে তাঁরা ঘটনাটি জানতে পারেন। পরবর্তী সময়ে ব্লাস্টের পক্ষ থেকে তাঁর মায়ের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করে শ্রীধামকে কারামুক্ত করতে চাইলেও তাঁর মা রাজি হননি। ফলে, তাঁকে মুক্ত করাও সম্ভব হয়নি।

এ বছরের ১৯ জানুয়ারি ফরিদপুরের জেলা ও দায়রা জজ মো. সেলিম মিয়া ফরিদপুর জেলা কারাগার পরিদর্শনের সময় শ্রীধামের সঙ্গে কথা হলে ব্লাস্টের প্যারালিগ্যালরা শ্রীধামের সার্বিক বিষয় উপস্থাপন করেন। পরবর্তী সময়ে জেলা জজ শ্রীধামের জামিনের ব্যবস্থা করার জন্য ব্লাস্টকে উদ্যোগ নিতে নির্দেশ দেন। গতকাল মঙ্গলবার ব্লাস্ট ফরিদপুর ইউনিটের আইনজীবী অর্চনা দাস জেলার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে শ্রীধামের জামিনের আবেদন করলে বিচারক হাকিম মো. ওসমান গণি তা মঞ্জুর করেন। পরে গতকাল সন্ধ্যায় শ্রীধাম কারাগার থেকে বের হন।

শ্রীধাম কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর আজ বুধবার কথা হয় তাঁর মা টুকটুকি সাহার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘শ্রীধামকে নিয়ে অনেক সমস্যায় আছি। ও নেশাগ্রস্ত। এর আগে কুষ্টিয়ায় এক মাদক নিরাময় কেন্দ্রে তার চিকিৎসা করিয়েছি। কিন্তু সে ভালো হয়নি। ফলে বাধ্য হয়েই দীর্ঘদিন ওকে কারাগারে নিরাপদ হেফাজতে রাখা হয়। আমি একজন বিধবা। সব সম্পত্তি শ্রীধাম বিক্রি করে দিলে আমি কোথায় গিয়ে দাঁড়াব? তাই আমি চাই এমন একটি ব্যবস্থা করা হোক, যাতে আমার ছেলে সম্পত্তি বিক্রি করতে না পারে। আমরা একসঙ্গেই থাকতে চাই।’

শ্রীধাম বলেন, ‘আমি আগে নেশা করতাম। বাড়ির জিনিসপত্র বিক্রি করতাম, ভাঙচুরও করতাম। কিন্তু এখন নেশা করি না। আমি মাকে নিয়েই থাকতে চাই। মাকে আমি সব সম্পত্তি লিখে দিতেও প্রস্তুত।’

ব্লাস্ট ফরিদপুর ইউনিটের সমন্বয়কারী শিপ্রা গোস্বামী প্রথম আলোকে বলেন, হতে পারে শ্রীধাম মাদকাসক্ত। কিন্তু কোনো অপরাধ ছাড়া বিনা কারণে একজনকে এভাবে দিনের পর দিন আটকে রাখা মানবাধিকার লঙ্ঘন। এ কারণে ব্লাস্টের উদ্যোগে জেলা জজের মাধ্যমে দীর্ঘদিন পর শ্রীধামকে মুক্ত করা হয়েছে।