এখনো অবস্থানে মুকিমুল

ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চার ছাত্রকে পিটিয়েছে ছাত্রলীগ। এর প্রতিবাদ ও বিচার চেয়ে অবস্থান নিয়েছেন মারধরে আহত শিক্ষার্থী মুকিমুল হক চৌধুরী। রাজু ভাস্কর্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ২৩ জানুয়ারি। ছবি: হাসান রাজা
ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চার ছাত্রকে পিটিয়েছে ছাত্রলীগ। এর প্রতিবাদ ও বিচার চেয়ে অবস্থান নিয়েছেন মারধরে আহত শিক্ষার্থী মুকিমুল হক চৌধুরী। রাজু ভাস্কর্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ২৩ জানুয়ারি। ছবি: হাসান রাজা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মুকিমুল হক চৌধুরী এখনো অবস্থানে আছেন। গত মঙ্গলবার শিবির সন্দেহে ঢাবির শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের চার শিক্ষার্থীকে পেটায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। তিন দফায় আড়াই ঘণ্টা ধরে তাঁদের পেটানো হয়। ওই ঘটনার শিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মুকিমুল হক চৌধুরী বিচার চেয়ে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে অবস্থান নেন।

গতকাল বুধবার বিকেল থেকে আজ বৃহস্পতিবার শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এখনো অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন মুকিমুল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দোষীদের বিচার না করা পর্যন্ত তিনি এই অবস্থান চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

মুকিমুলের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে তাঁর সঙ্গে অবস্থান নিয়েছেন ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেনসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী। মুকিমুলের সারা মুখে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। হাঁটতে গিয়ে ভারসাম্য রক্ষার জন্য তিনি স্ট্রেচার ব্যবহার করছিলেন।

গত মঙ্গলবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে শিবির সন্দেহে প্রথমে হল সংসদের কক্ষে, এরপর হলের ছাদে, সর্বশেষ হলের অতিথিকক্ষে চার শিক্ষার্থীকে পেটায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ব্যবহার করা হয় হাতুড়ি আর ডিশের তার। শেষমেশ আবাসিক শিক্ষককে ডেকে পুলিশে দেওয়া হয় চার শিক্ষার্থীকে। অভিযোগ, এই চারজন ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে প্রায় ১১ ঘণ্টা শাহবাগ থানার হাজতে রাখার পর পুলিশ তাঁদের ছেড়ে দেয়। অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে কি না, এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর মেলেনি পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে। এই হামলার শিকার হন মুকিমুল।

মারধরের শিকার বাকি তিনজন হলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সানওয়ার হোসেন, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মিনহাজ উদ্দীন এবং একই বর্ষের আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী আফসার উদ্দীন। তাঁদের অভিভাবকদের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের শিক্ষার্থীরা জানান, ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ততার অভিযোগ এনে গত বছরের অক্টোবরেও মুকিমুল ও আফসারকে পুলিশে সোপর্দ করেছিলেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। সেবারও তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। এরপর থেকে তাঁরা হলেই থাকছেন।

নির্যাতনের শিকার মুকিমুল হক চৌধুরী ঘটনার বর্ণনা দিয়ে গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, হলের ৪০০৫ নম্বর কক্ষে মঙ্গলবার রাতে তিনি গল্পের বই পড়ছিলেন। সাড়ে ১১টার দিকে হল শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি আনোয়ার হোসাইন ফোন দিয়ে অতিথিকক্ষে যেতে বলেন। সেখানে হল শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি কামাল উদ্দিন, হল সংসদের সহসভাপতি (ভিপি) সাইফুল্লাহ আব্বাসীসহ ৮ থেকে ১০ জন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী ছিলেন। অতিথিকক্ষে এক ছাত্রের জন্মদিনের অনুষ্ঠান চলায় ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা তাঁকে নিয়ে হল সংসদের কক্ষে চলে যান। আনোয়ার হোসাইন তখন তাঁকে মুঠোফোনে কয়েকটি স্ক্রিনশট দেখিয়ে এগুলো কী জিজ্ঞেস করেন। তিনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন না, এমনটা বলার পর তাঁকে চড়থাপ্পড় দেন তিনি।

ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চার ছাত্রকে পিটিয়েছে ছাত্রলীগ। এর প্রতিবাদ ও বিচার চেয়ে শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন। রাজু ভাস্কর্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ২৩ জানুয়ারি। ছবি: হাসান রাজা
ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চার ছাত্রকে পিটিয়েছে ছাত্রলীগ। এর প্রতিবাদ ও বিচার চেয়ে শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন। রাজু ভাস্কর্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ২৩ জানুয়ারি। ছবি: হাসান রাজা

মুকিমুল বলেন, স্ক্রিনশটগুলো আবার দেখালে তিনি সেখানে শিবির নিয়ে কিছু কথোপকথন দেখতে পান। এগুলো তাঁর না বলে তিনি উত্তর দিলে আবারও তাঁকে পেটানো হয়। হল সংসদের কোনো এক জায়গা থেকে ছাত্রলীগ নেতারা তখন একটি হাতুড়ি বের করেন। এরই মধ্যে সানোয়ারকে ডেকে নিয়ে আসেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। দুজনকে হলের ছাদে নিয়ে যাওয়া হয়। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাঁদের বেধড়ক কিলঘুষি দিতে থাকেন। এ সময় হল শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মাহফুজুর রহমান ডিশের তার দিয়ে বাড়ি দিতে থাকেন। সহসভাপতি কামাল উদ্দিন হাতুড়ি দিয়ে হাত ও পায়ের জোড়ায় জোড়ায় বাড়ি মারেন। দেড়টা পর্যন্ত কয়েক দফায় পেটানোর পর তাঁদের হলের অতিথিকক্ষে নিয়ে আসা হয়। তখন মিনহাজ ও আফসারকে অতিথিকক্ষে নিয়ে আসা হয়। হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমির হামজা তখন তাঁকে (মুকিমুল) অতিথিকক্ষ থেকে বের করে হলের পড়ার কক্ষের সামনে নিয়ে যান। সেখানে আবারও তাঁকে পেটান।

এ সময় হলের আবাসিক শিক্ষক মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন ঘটনাস্থলে আসেন। তাঁর সামনে চারজনকেই পেটাতে থাকেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। একপর্যায়ে পুলিশ ও প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যরা এলে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা তাঁদের পুলিশের হাতে তুলে দেন। পুলিশ তাঁকে ও সানোয়ারকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়।

জানতে চাইলে আবাসিক শিক্ষক বিল্লাল হোসেন মারধরের কোনো ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করেন।

চার ছাত্রকে নির্যাতনের প্রতিবাদে গতকাল বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহসভাপতি (ভিপি) নুরুল হকের নেতৃত্বাধীন ১২ ছাত্রসংগঠনের জোট সন্ত্রাসবিরোধী ছাত্রঐক্য।