ঢাকার দুই সিটিতে বিএনপির প্রার্থীদের ১৮২৫ মামলা, আ.লীগের ৫৩

১ হাজার ৮২৫টি মামলা মাথায় নিয়ে ঢাকার দুই সিটিতে কাউন্সিলর পদে লড়ছেন বিএনপি-সমর্থিত ১০০ প্রার্থী। সে তুলনায় প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা নগণ্য। আওয়ামী লীগের মাত্র ১৪ জনের বিরুদ্ধে এই মুহূর্তে মামলা আছে। মামলার সংখ্যা ৫৩।

এসব মামলা নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা চিন্তিত নন। সবাই জামিনে আছেন। তবে বিএনপির প্রার্থীদের উদ্বেগ আছে। তাঁদের দাবি, সব রাজনৈতিক মামলা। বেশির ভাগই একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে দেওয়া ‘গায়েবি মামলা’। তাঁদের আশঙ্কা, ভোট গ্রহণের সময় আরও এগিয়ে এলে এসব মামলা দিয়ে তাঁদের হয়রানি করা হতে পারে।

দুই সিটিতে মামলা নেই, বিএনপির এমন কাউন্সিলর প্রার্থীর সংখ্যা ২৩। যে ১০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা আছে, সে মামলাগুলোর ৬০ শতাংশই হয়েছে ২০১৭ ও ২০১৮ সালে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে। বিশেষ ক্ষমতা আইন, বিস্ফোরক দ্রব্য আইন, সরকারি কাজে বাধা, বিনা অনুমতিতে সভা-সমাবেশ করা ও ভাঙচুর-সহিংসতার দায়ে করা এসব মামলার বেশির ভাগের বাদী পুলিশ। তখন এসব মামলা ‘গায়েবি’ মামলা নামে পরিচিতি পায়। এর বাইরে ২০১৪ ও ২০১৫ সালে বিরোধী দলের আন্দোলনের সময়ের নাশকতার মামলার আসামিও আছেন অনেকে।

অপর দিকে দুই সিটির আওয়ামী লীগ-সমর্থিত ১৪ কাউন্সিলর প্রার্থীর বিরুদ্ধে মামলা আছে ৫৩টি। এর মধ্যে মাদক, দুর্নীতি, নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের মামলাও রয়েছে। দক্ষিণ সিটির ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদপ্রার্থী আবদুল বাসিত খান ২০১৮ সালের একটি ধর্ষণ মামলার আসামি। মামলাটি এখন স্থগিত আছে। তিনি জামিনে আছেন।

এর বাইরে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে অতীতে আরও ২১টি মামলা ছিল, যেগুলো বিগত বিএনপি সরকার ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সেসব মামলার মধ্যে আটটি রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করা হয়েছে। ১৩টি মামলা থেকে আসামিরা অব্যাহতি পেয়েছেন।

রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে প্রার্থীদের জমা দেওয়া দুই প্রধান রাজনৈতিক দল-সমর্থিত ২৫২ কাউন্সিলর প্রার্থীর হলফনামা পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মোট সাধারণ ওয়ার্ড ১২৯টি। প্রতিটিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আছেন। তাঁদের দুজন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। চারটিতে বিএনপির প্রার্থী নেই। বাকি ১২৫টির মধ্যে ১২৩ জনের হলফনামা নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে পাওয়া গেছে।

হলফনামা পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিএনপির প্রার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলার আসামি উত্তর সিটির ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা ৭০ টি। তাঁর ৯ পৃষ্ঠার হলফনামার অর্ধেকের বেশি জায়গাজুড়ে আছে এসব মামলার বিবরণ। আনোয়ারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখনই যেভাবে চাপ তৈরি করছে, তাতে সামনে মামলা নিয়ে কী হবে, তা বুঝতে পারছি না।’

এরপর আছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটির ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী সিরাজুল ইসলাম। তাঁর মামলা ৬৩টি। তিনি বিএনপির ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সহসভাপতি। তাঁর বিরুদ্ধে ৪২টি মামলা হয়েছে ২০১৭ ও ২০১৮ সালে। বাকিগুলো ২০১১ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে করা।

সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এগুলো সব রাজনৈতিক মামলা। আমাকে রাজনীতির মাঠ থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্যই মামলাগুলো করা হয়েছিল।’ সবগুলো মামলায় তিনি জামিনে আছেন তারপরও আশঙ্কা, ‘সরকার যদি চায়, তাহলে তো হেনস্তা করতেই পারে।’

দক্ষিণ সিটির ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী মীর আশরাফ আলীর বিরুদ্ধে মামলা ৪৫টি। তাঁর দাবি, সব রাজনৈতিক হয়রানির মামলা। এর মধ্যে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসেই তাঁর বিরুদ্ধে ১৪টি মামলা হয়। যখন তিনি বাইপাস সার্জারির জন্য হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন।

বর্তমানে জামিন থাকলেও মীর আশরাফ আলী শঙ্কায় আছেন নির্বাচনের আগ দিয়ে নতুন করে হয়রানির মুখে পড়েন কি না।

উত্তর সিটির ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থী মো. হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আছে ৪০টি মামলা। সবই ২০১৭ ও ২০১৮ সালে হয়েছে। হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরোয়ানা থাকা সব মামলায় আদালত থেকে জামিন নিয়েছিলাম। কিন্তু ২১ জানুয়ারি জানতে পারলাম একটা মামলায় আবার পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এখন বিষয়টা নিয়ে একটু শঙ্কায় আছি।’

কেবল পুরুষ নয়, সাধারণ ওয়ার্ডে বিএনপির নারী প্রার্থী ফেরদৌসী আহমেদের বিরুদ্ধেও একই ধরনের মামলা রয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে ছয়টি মামলার সবই ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে হয়েছে। তাঁর দাবি, ‘সবই গায়েবি মামলা।’

অবশ্য এসব মামলা নিয়ে চিন্তিত নন বলে জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি ঢাকা দক্ষিণে দলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের করা এসব মামলার কারণ, উদ্দেশ্য সবাই জানে। যাঁদের বিরুদ্ধে মামলাগুলো হয়েছে, তাঁরা সবাই বিএনপির নিপীড়িত নেতা-কর্মী, পরীক্ষিত সৈনিক। এ নিয়ে আমরা ভাবিত নই।’

>দুই সিটি নির্বাচন: বিএনপির ১২৫ কাউন্সিলর পদপ্রার্থীর মধ্যে ১০০ জনই মামলার আসামি। আ. লীগের ১২৯ প্রার্থীর মধ্যে মামলা আছে ১৪ জনের বিরুদ্ধে।

বিএনপির প্রার্থীদের মধ্যে ১০০ জনই যেখানে মামলাকে কেন্দ্র করে শেষ মুহূর্তে হয়রানির শঙ্কায় আছেন। সেখানে আওয়ামী লীগের মাত্র ১৪ জন এই সমস্যায় আছেন। যদিও অনেকে বলেছেন, এ নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই তাঁদের।

অবশ্য বিএনপির প্রার্থীরা এসব মামলাকে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা বলে সরকারকে দায়ী করলেও এটা মানতে নারাজ মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব এস এম মান্নান। তিনি প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, সরকার উদ্দেশ্যমূলকভাবে কাউকে হয়রানি করছে না। কেউ যদি গাড়ি পোড়ায়, মানুষ খুন করে, সেটা কি রাজনৈতিক মামলা হবে?

অবশ্য বিএনপির নেতারা অভিযোগ করে আসছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাঁদের দলের নেতাদের মামলাগুলো প্রত্যাহার বা প্রভাব খাটিয়ে অব্যাহতি নিয়ে নিয়েছেন। দক্ষিণ সিটির ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ-সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী মো. আবুল কালামের বিরুদ্ধে ২০০৫ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে সম্পত্তি আত্মসাৎ, সহিংসতা, অবৈধ অস্ত্র ও বিস্ফোরক রাখার অভিযোগে পাঁচটি মামলা হয়েছিল। তাঁর হলফনামায় বলা হয়, মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হয়েছে।

দক্ষিণ সিটির ৫২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী মোহাম্মদ নাসিম মিয়ার নামে ২০০৩ সালে অস্ত্র মামলা হয়েছিল। নাসিম হলফনামায় উল্লেখ করেন, ২০১২ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মামলাটি প্রত্যাহার করা হয়।

একইভাবে উত্তর সিটির আওয়ামী লীগের ফরিদুর রহমান খানের বিরুদ্ধে ২০০০ ও ২০০৯ সালে হত্যা ও চাঁদাবাজির অভিযোগে দুটি মামলা হয়েছিল। দুটি থেকেই তিনি অব্যাহতি পেয়েছেন। ফরিদুর রহমান খান দাবি করেন, তিনি অব্যাহতি পেয়েছেন আদালতে আইনি লড়াই করে।

প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের কাউন্সিলর প্রার্থীদের মামলার সংখ্যার এমন পার্থক্যের বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দেশে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন সবই হয় ক্ষমতাসীন দলের ছত্রচ্ছায়ায়। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে সরকার-ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে মামলা হয় না। আবার বিরোধী দলের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা হয়। সেটাও রাজনৈতিক কারণেই। এটা তারই প্রতিফলন।’