রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে অন্তর্বর্তী ট্রাইব্যুনাল দরকার: ইয়াং হি লি

রাজধানীর লা মেরিডিয়ান হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন মিয়ানমারের মানবাধিকার বিষয়ে জাতিসংঘের বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ার ইয়াং হি লি। ছবি: রাহীদ এজাজ
রাজধানীর লা মেরিডিয়ান হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন মিয়ানমারের মানবাধিকার বিষয়ে জাতিসংঘের বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ার ইয়াং হি লি। ছবি: রাহীদ এজাজ

মিয়ানমারের মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ের ইয়াংহি লি রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যার জন্য মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বিচারের সুপারিশ করবেন। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার বিচারের জন্য তিনি জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে প্রতিবেদন দেওয়ার সময় একটি নতুন অন্তর্বর্তীকালীন আন্তর্জাতিক আদালত গঠনের প্রস্তাব দেবেন।

আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর লা মেরিডিয়ান হোটেল ইয়াংহি লি এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান।

মিয়ানমারের মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ের হিসেবে ইয়াংহি লির ছয় বছরের মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে। তাই মেয়াদের শেষ প্রান্তে এসে মার্চে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে প্রতিবেদন দেওয়ার আগে তিনি গত ১৭ জানুয়ারি শেষ বারের মত বাংলাদেশে আসেন। এ সময় তিনি সরকারি, বেসরকারি এবং আন্তর্জাতিক অংশীজনের সঙ্গে কথা বলেন। কক্সবাজারে দুই দিন থেকে রোহিঙ্গাদের মনোভাব বুঝেছেন। ঢাকা ছাড়ার আগে আজ দুপুরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। সমস্যা সমাধানের উপায় নিয়ে নিজের ভাবনা তুলে ধরেন ইয়াংহি লি।

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর যে নৃশংসতা হয়েছে তাকে ‘সম্ভাব্য গণহত্যা’ হিসেবে অভিহিত করেন জাতিসংঘের বিশেষ ওই র‌্যাপোর্টিয়ের। ইয়াংহি লি বলেন, রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতা দায়বদ্ধতার জন্য একটি অন্তর্বর্তীকালীন আন্তর্জাতিক আদালত গঠন করা উচিত। এই আদালতের পরিসর ও কাজের পরিধি কেমন হবে সেটি মার্চে মানবাধিকার পরিষদের প্রতিবেদনে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হবে।

প্রস্তাবিত ওই অন্তর্বর্তীকালীন আদালত সম্পর্ক বিস্তারিত জানতে চাইলে জাতিসংঘের বিশেষ ওই র‌্যাপোর্টিয়ের বলেন, সিয়েরালিওন, রুয়ান্ডা বা বসনিয়া হার্জেগোভিনায় যেভাবে গণহত্যার বিচার হয়েছে, এ ক্ষেত্রেও একই ধরনের সুপারিশ করব আমি। তবে এটি অন্য আদালত যেমন আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) কিংবা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সম্পূরক হিসেবে কাজ করবে না। এটি আলাদাভাবে কাজ করবে।

গত ছয় বছর ধরে মিয়ানমারের বিষয়ে র‌্যাপোটিয়ার হিসেবে কাজ করছেন ইয়াংহি লি। এবার নিয়ে ছয় বছরে চারবার বাংলাদেশে এলেও ২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে তিনি আর মিয়ানমার যেতে পারছেন না। এর আগে জাতিসংঘের বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ের হিসেবে দুবার দেশটিতে গিয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনে মিয়ানমার ২০১৮ সালে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে তাঁকে বাদ দেওয়ার আবেদন জানিয়েছিল। যদিও মিয়ানমারের ওই অনুরোধ অগ্রাহ্য করে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত তাঁকে দায়িত্বে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ইয়াংহি লি বলেন, আমার ৬ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে মিয়ানমারে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হত্যা, ধর্ষণসহ নানান নৃশংসতার মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধ এবং গণহত্যার মত মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটছে। মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হওয়া লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি মিয়ানমারের সেনা সদস্য এবং নিরাপত্তা বাহিনীর কীভাবে রোহিঙ্গাদের ওপর ধর্ষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন এবং হত্যা চালিয়েছে। এসব নৃশংসতার বিচার পাওয়ার মতো পরিবেশ মিয়ানমারে নেই। মিয়ানমারের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন মেনে চলা উচিত, এ জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উদ্যোগী হতে হবে।

ইয়াংহি লি জানান, জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান মিশন যে প্রতিবেদন দিয়েছে তা বাস্তবায়নের জন্য মানবাধিকার পরিষদের প্রতিবেদনে জোরালো সুপারিশ করবেন।ওই প্রতিবেদনে সত্য উঠে এসেছে।

ইয়াংহি লি বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য মিয়ানমারকে জবাবদিহির আওতায় আনতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে উদ্যোগ নিতে বলব। নিরাপত্তা পরিষদে চীন এবং রাশিয়া মিয়ানমারকে যেভাবে সমর্থন জানাচ্ছে তা লজ্জাজনক।

গণহত্যাসহ সব ধরনের নিপীড়নের হাত থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষায় অন্তর্বর্তী ব্যবস্থার বিষয়ে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) বিচার চলছে। আজই সেই আদালতের অন্তর্বর্তী আদেশ ঘোষিত হবে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মিয়ানমার সরকারের দীর্ঘ কয়েক দশকের জাতিগত বৈষম্য ও নিপীড়ন এবং ২০১৭ সালের সেনা অভিযানের পটভূমিতে গাম্বিয়া এই সুরক্ষার আবেদন করে।

আজ ইয়াং হি লি বলেন, আইসিজের বিচার যেভাবে চলছে, সেভাবেই চলবে। এর পাশাপাশি এই অ্যাডহক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন দরকার। এটা কীভাবে কাজ করবে, এর ধরন কেমন হবে, তা মার্চের মানবাধিকার কাউন্সিলের অধিবেশনে তুলে ধরা হবে।

২০১৭ সালে বৌদ্ধ আধিপত্যের দেশ মিয়ানমারে সামরিক অভিযানে রাখাইন রাজ্যে হাজার হাজার রোহিঙ্গা হত্যার ঘটনা ঘটে। সেনাবাহিনীর বর্বর নির্যাতনের মুখে প্রাণ বাঁচাতে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১১ লাখ।