সীমান্তে তিন দিনে সাত বাংলাদেশি নিহত

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

নওগাঁর পোরশা সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে গতকাল বৃহস্পতিবার তিন বাংলাদেশি নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এর মধ্যে দুই বাংলাদেশির মৃতদেহ বিএসএফ সদস্যরা নিয়ে গেছেন। এ নিয়ে গত তিন দিনে দেশের তিনটি সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে ছয়জন বাংলাদেশি নিহত হলেন।

এ ছাড়া ভারতের বন্যাবাড়িয়া সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশের সময় বিএসএফের নির্যাতনে আহত আরেক বাংলাদেশি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

প্রথম আলোর নওগাঁ প্রতিনিধি জানান, গতকাল ভোরে সদর উপজেলার হাঁপানিয়া সীমান্তচৌকির (বিওপি) পাশে দুয়ারপাল এলাকায় বিএসএফের গুলিতে তিন বাংলাদেশি নিহত হন। তাঁরা হলেন সদর উপজেলার বিষ্ণুপুরের শুকরা কুমারের ছেলে রনজিত কুমার (২৪), চকবিষ্ণুপুর দিঘীপাড়ার মৃত খোদাবক্সের ছেলে মফিউ উদ্দন (৩৮) ও কাঁটাপুকুর গ্রামের মৃত জিল্লুর রহমানের ছেলে কামাল আহমেদ (৩২)।

বিজিবি ও স্থানীয় বাসিন্দা সূত্রে জানা গেছে, ওই তিন বাংলাদেশিকে ভারতের কাদ্যারীপাড়া ক্যাম্পের বিএসএফ সদস্যরা গুলি করেন। হাঁপানিয়া বিওপির বিজিবি সদস্যরা গুলির শব্দ শুনেছেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে মফিজ উদ্দিনের লাশ দুয়ারপাল সীমান্ত এলাকার ২৩১ নম্বর প্রধান স্তম্ভের ১০ নম্বর উপস্তম্ভের কাছে বাংলাদেশ সীমান্তের প্রায় ২০০ গজ ভেতরে নীলমারী বিল এলাকায় পাওয়া যায়। অপর দুজন রনজিত কুমার ও কামাল আহমেদের লাশ পড়ে ছিল সীমান্তের শূন্যরেখা থেকে ভারতের অংশে। তাঁদের লাশ বিএসএফ সদস্যরা নিয়ে যান।

নিহত মফিজ উদ্দিনের খালাতো ভাই জিয়ারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মফিজ টাকার বিনিময়ে রাখাল হিসেবে ভারত থেকে গরু নিয়ে আসতেন। গত বুধবার দিবাগত রাতে মফিজ আরও ১০-১২ জনের সঙ্গে গরু আনতে হাঁপানিয়া সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারতে ঢোকেন। ভোরে গরু নিয়ে ফেরার পথে বিএসএফ সদস্যরা তাঁদের তাড়া করেন। অন্যরা পালিয়ে আসতে পারলেও মফিজ, কামাল ও রনজিত বিএসএফের গুলিতে মারা পড়েন।

এ ঘটনায় গতকাল বিকেল পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত বিএসএফের কমান্ড্যান্টের সঙ্গে বিজিবির নওগাঁ ব্যাটালিয়নের অধিনায়কের পতাকা বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে বিজিবির অধিনায়ক এ কে এম আরিফুল ইসলাম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, গুলি করে তিন বাংলাদেশিকে হত্যার কথা বিএসএফ স্বীকার করেছে। তারা এই ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছে। যে দুজনের লাশ বিএসএফ নিয়ে গেছে, তাঁদের লাশ ময়নাতদন্ত শেষে আজ শুক্রবার ফেরত দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে।

এর আগে বুধবার সকালে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধার গোতামারী ইউনিয়নের দইখাওয়া সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে দুই বাংলাদেশি নিহত হন। দুজনের নামই সুরুজ মিয়া। ৬০৭ নম্বর সীমান্ত পিলারের আওতাধীন ৪ নম্বর সাবপিলার এলাকায় দুজনের গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়। পরে পতাকা বৈঠক করে বিজিবি ঘটনাস্থল থেকে দুজনের লাশ উদ্ধার করে নিয়ে আসে।

একই দিন ভারত থেকে অবৈধভাবে দেশে ফেরার পথে যশোরে বন্যাবাড়িয়া সীমান্তে বিএসএফের হাতে ধরা পড়েন হানেফ আলী জোয়ার্দার (৩২) নামের এক বাংলাদেশি। পারিবারিক সূত্র বলছে, বিএসএফ সদস্যের নির্যাতনে হানেফ অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাঁকে বনগাঁ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বেলা দুইটার দিকে সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়।

হানেফ আলীর চাচা শহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে জানান, হানেফ তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করে সোমবার বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। এরপর অবৈধভাবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মধ্যমগ্রামে তাঁর মামার বাড়িতে যান। বুধবার সকালে তিনি সেখান থেকে বাড়ি ফেরার পথে বিএসএফের হাতে ধরা পড়েন।

এর আগের দিন মঙ্গলবার দুপুরে পঞ্চগড়ের হাঁড়িভাসা ইউনিয়নের মোমিন পাড়া সীমান্ত থেকে হাসান আলী (২৫) নামের এক বাংলাদেশি তরুণের লাশ উদ্ধার করে বিজিবি। বিএসএফের গুলিতে ওই তরুণ নিহত হয়েছেন বলে ধারণা করছেন স্থানীয় লোকজন। হাসান আলী গরু ব্যবসায়ী ছিলেন বলে জানা গেছে। ৫৬ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মামুনুল হক প্রথম আলোকে বলেন, সীমান্তে বাংলাদেশির লাশ পড়ে থাকার ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করা হচ্ছে।

পঞ্চগড়ের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইউসুফ আলী প্রথম আলোকে বলেন, লাশটি সীমান্ত এলাকার বাংলাদেশ অংশে পাওয়া গেছে। লাশের ডান কানের কাছে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে এবং রক্ত জমাট বাঁধা ছিল। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পেলে মৃত্যুর সঠিক কারণ নিশ্চিত হওয়া যাবে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, চলতি মাসের ২৩ দিনে সীমান্তে মোট ১০ জন বাংলাদেশি বিএসএফের গুলিতে নিহত হলেন। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ৩৭। ২০১৮ সালে নিহত হন ১৪ বাংলাদেশি।

গত মঙ্গলবার থেকে পরপর তিন দিনে সাত বাংলাদেশি নিহত হন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিবির পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দীন আহমেদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের গরু ব্যবসায়ীরা গরু আনতে যখন সীমান্তের কাছাকাছি যায়, তখনই এ রকম ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশিরা যাতে সীমান্তে না যায়, সে জন্য বিজিবি ওই সব এলাকায় সচেতনতামূলক বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তারপরও এটা থামছে না।

বিজিবির এই কর্মকর্তা বলেন, সীমান্ত হত্যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কেউ ভুলবশত বা অবৈধভাবে ভারতের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়লে, বাংলাদেশ-ভারত চুক্তি অনুযায়ী তাকে বিজিবির কাছে হস্তান্তর করার কথা। কিন্তু বিএসএফ সে অনুযায়ী কার্যক্রম গ্রহণ না করে বাংলাদেশি নাগরিকদের ওপর গুলিবর্ষণ করছে। প্রতিটি ঘটনায় বিজিবি জোরালো প্রতিবাদলিপি পাঠায়। এ ছাড়া বিভিন্ন পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে বিএসএফকে বলা হয়। তবে বিএসএফ দাবি করে, তাদের ওপর যখন হামলা করা হয়, তখন প্রাণ রক্ষায় তারা নন-লেথাল (প্রাণঘাতী নয় এমন) গুলি করেন, যা গ্রহণযোগ্য নয়।

[তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর প্রতিনিধি, নওগাঁ, লালমনিরহাট, যশোর ও পঞ্চগড়]