এই আদেশ মানা বাধ্যতামূলক

জন ফ্রেডরিক প্যাকার।  ছবি: প্রথম আলো
জন ফ্রেডরিক প্যাকার। ছবি: প্রথম আলো
জন ফ্রেডরিক প্যাকার। কানাডার অটোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদে আন্তর্জাতিক সংঘাতবিষয়ক অধ্যাপক। জাতিসংঘের সাবেক মানবাধিকার কর্মকর্তা এবং মিয়ানমারে জাতিসংঘের প্রথম বিশেষ র‍্যাপোর্টিয়ারের সহকারী হিসেবে ১৯৯২ সাল থেকে তিনি রোহিঙ্গা পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছেন। গতকাল তিনি কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনে ছিলেন। মুঠোফোনে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান


প্রথম আলো: আপনি কি মনে করেন, আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) আদেশের ফলে চলমান রোহিঙ্গা গণহত্যা বন্ধ হবে? কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের কী প্রতিক্রিয়া দেখলেন? 

জন ফ্রেডরিক প্যাকার: রোহিঙ্গাদের মধ্যে একটা স্বস্তির ছাপ ছিল লক্ষণীয়। এটা স্পষ্ট যে মিয়ানমারকে এখন তার আচরণে কিছুটা পরিবর্তন আনতেই হবে। সুতরাং এটা কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় যে এই আদেশের পরে তারা কীভাবে তাদের আচরণে পরিবর্তন আনে। এটা খুবই স্পষ্ট যে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি আদালতে নিজের পক্ষে যেসব যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছিলেন, আদালত তাতে কোনোভাবেই সন্তুষ্ট হননি। এটি সর্বসম্মত একটি রায়। এমনকি মিয়ানমারের এবং শক্তিশালী রাষ্ট্রের বিচারকেরাও একমত হয়েছেন। সুতরাং এখন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাজ হবে এ বিষয়ে তদারক করা। আমরা এখন অবশ্যই আশা করতে পারি যে মিয়ানমারকে কিছু একটা পদক্ষেপ নিতে হবে। তাকে অবশ্যই কিছু করে দেখাতে হবে।

প্রথম আলো: ট্রিনিটি কলেজের এডজাঙ্কট লেকচারার ও আইসিজের সাবেক আইন কর্মকর্তা মাইক বেকার সতর্ক করেছেন যে অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ। তাই ওভার এস্টিমেট করা সমীচীন নয়।
জন প্যাকার: এটা অবশ্যই সত্য। বিচারকেরা মেরিটে না গিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটা একটা স্ট্র্যাটেজি। আমি মনে করি, এখন যা গুরুত্বপূর্ণ এবং সব থেকে বড় করে দেখতে হবে যে আদালত সর্বসম্মতিক্রমে এই সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন এবং এর স্পষ্ট অর্থ হলো মিয়ানমারের যুক্তিতর্কে তাঁরা কোনোভাবেই নিজেদের চালিত করেননি। গাম্বিয়ার যুক্তিতর্ক সম্পূর্ণরূপে সফল হয়েছে। এতটা সাফল্য নজিরবিহীন।

প্রথম আলো: এই আদেশ মানা মিয়ানমারের জন্য বাধ্যতামূলক?
জন প্যাকার: এটা বাধ্যতামূলক। এটা কিন্তু এখন জাতিসংঘের গণহত্যা কনভেনশনের ৪১ অনুচ্ছেদের আওতায় নিরাপত্তা পরিষদে আপনাআপনি চলে যাবে। আদালতের আদেশ তামিলে মিয়ানমারকে তাই অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন আদেশের বিষয়ে আপিলের সুযোগ নেই। আমি মনে করি, তারা আদালতের আদেশ বিষয়ে কনটেস্ট না-ও করতে পারে।

প্রথম আলো: কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মধ্যে শঙ্কা আছে আদালতের নিজের আদেশ কার্যকর করার কোনো হাতিয়ার নেই, তাই মিয়ানমার এটা অগ্রাহ্য করতে পারে।
জন প্যাকার: না, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদই তার হাতিয়ার। নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এই আদেশ বাস্তবায়ন করা যাবে। নিরাপত্তা পরিষদ এখন কী করে, সেটা আমরা দেখব। এখন বিশ্বের সরকারগুলোর ওপর দায়িত্ব বর্তায় যে মিয়ানমার যাতে আদালতের এই আদেশ মেনে চলে।

প্রথম আলো: আল-জাজিরা বলেছে, আদেশ না মানলে গাম্বিয়া বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদে নিতে পারে?
জন প্যাকার: আদালতের আদেশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে চলে যাবে। কারও রেফার করার প্রয়োজন নেই। নিরাপত্তা পরিষদকে আদেশ বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিতে হবে। ঠিক কী প্রক্রিয়ায় এটি নিরাপত্তা পরিষদে যাবে, সেটা আমি জানি না। তবে আইনের কথা হচ্ছে, এটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিরাপত্তা পরিষদে চলে যাবে। মিয়ানমার আগামী চার মাস পরে প্রথম প্রতিবেদন এবং এরপর ছয় মাস অন্তর রিপোর্ট দিল কি না, সেটা তদারকির আইনি দায় নিরাপত্তা পরিষদের।

প্রথম আলো: কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদে এর আগে চীন ও রাশিয়ার যে ভূমিকা, সেটা বিবেচনায় নিলে আমরা কীভাবে আশাবাদী হতে পারি যে আদেশ তারা মানবে?
জন প্যাকার: হ্যাঁ, আমরা সেটা জানি না। আমরা একটা পূর্বানুমান করছি। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, কে জানত আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে চীনা বিচারক এ বিষয়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্তে পৌঁছাবেন? কে জানত মিয়ানমারের নিয়োগ করা অ্যাডহক বিচারক সিদ্ধান্ত দেবেন গাম্বিয়ার পক্ষেই। কে এসব জানত? সামনের দিনগুলোতে নিরাপত্তা পরিষদ যদি এ বিষয়ে নির্বিকার থাকে, তাহলে সেটা কার্যত সমগ্র জাতিসংঘ ব্যবস্থা এবং সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে চ্যালেঞ্জ করা হবে। আইসিজের আদেশ অমান্য করতে পারে, এমন অন্য কোনো শ্রেয়তর সংস্থার অস্তিত্ব জাতিসংঘ ব্যবস্থায় নেই।

প্রথম আলো: ২০১৭ সালে স্যাব্রেনিৎসা গণহত্যার মামলায় আদালত গণহত্যা ও সশস্ত্র সংঘাত রোধে পদক্ষেপ নিতে বলেছিল। কিন্তু তখন আমরা আইসিজের সিদ্ধান্ত ‘অকার্যকর’ থাকতে দেখেছি।
জন প্যাকার: আপনি একটি সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন বিষয়কে মিশ্রিত করছেন। কারণ, সেই রায় ছিল মেরিটে, সেটা ছিল চূড়ান্ত। যেটা এখন তাৎপর্যপূর্ণ সেটা হলো, আদালতের এই আদেশ যদি মিয়ানমার না মেনে চলে, তাহলে সেটা মিয়ানমারই শুধু নয়, নিরাপত্তা পরিষদ এবং জাতিসংঘ সদস্যরাষ্ট্রগুলো যারা মিয়ানমারের সঙ্গে নানাভাবে সম্পর্ক রক্ষা করে চলবে, তাদের একটা দায় সবার ওপরই বর্তাবে। সেটা একটা বিরাট প্রশ্ন হয়ে দেখা দেবে। এটাকে জাতিসংঘের সনদ এবং একটা সাধারণ ও আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন হিসেবে দেখা দেবে।

প্রথম আলো: আদেশটি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমার চলমান দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় কী প্রভাব ফেলবে?
জন প্যাকার: আমি মনে করি, মিয়ানমার এখন রাখাইনের সাধারণ পরিস্থিতির দিকে নজর দেবে। তবে মিয়ানমার যদি আন্তর্জাতিক আদালতের আদেশ অগ্রাহ্য করে, তাহলে আমি এটা বুঝতে পারি না যে বাংলাদেশে কী করে তাকে বিশ্বাস করতে পারবে?

প্রথম আলো: আদালত বলেছেন, মিয়ানমার তার মৌখিক শুনানির সময় উল্লেখ করেছে যে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা করছে। এবং তারা রিকনসিলিয়েশন, শান্তি এবং স্থিতি প্রতিষ্ঠায় চেষ্টা করছে। সামরিক বাহিনীর জবাবদিহি করছে। কিন্তু আদালত বলেছেন, এগুলো অপর্যাপ্ত। রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নয়।
জন প্যাকার: যৌক্তিকভাবে এটাই সত্য। কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার অর্থ এই নয় যে সেসব চলমান গণহত্যা প্রতিরোধ এবং রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের তা সুরক্ষা দেওয়ার শর্ত পূরণ করে। বরং তাদের এভাবে প্রত্যাবাসনের জন্য অপেক্ষমাণ রাখাটাই গণহত্যার হুমকি নিশ্চিত করে। বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা গণহত্যার ঝুঁকিতে নেই। তারা অব্যাহতভাবে গণহত্যার ঝুঁকিতে রয়েছে মিয়ানমারে।