তাঁদের কষ্ট দেখার কেউ নেই

তীব্র শীতে রাতে ঘুম হয় না। তাই সকালে রোদের মধে্যই ঘুমাচ্ছে এই পথশিশু। সম্প্রতি টঙ্গী স্টেশন রোড এলাকায় ও শীতে রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মের মেঝেতে ঘুমিয়ে আছে শিশুটি। সম্প্রতি জয়দেবপুর রেলস্টেশনে।  ছবি: প্রথম আলো
তীব্র শীতে রাতে ঘুম হয় না। তাই সকালে রোদের মধে্যই ঘুমাচ্ছে এই পথশিশু। সম্প্রতি টঙ্গী স্টেশন রোড এলাকায় ও শীতে রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মের মেঝেতে ঘুমিয়ে আছে শিশুটি। সম্প্রতি জয়দেবপুর রেলস্টেশনে। ছবি: প্রথম আলো

পৌষ পেরিয়ে পড়েছে মাঘ। গত মাসে টানা তীব্র শীতের পর শীত কিছুটা কমলেও কয়েক দিনে আবার শীত বেশি অনুভূত হচ্ছে। সকালে ঘন কুয়াশার সঙ্গে সঙ্গে রাতভর টিপটিপ ঝরছে কুয়াশা-বৃষ্টি। এই শীতে গরম কাপড়ের অভাবে নিম্ন আয়ের লোকজন সবচেয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন। আর সবচেয়ে মানবেতর অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন বাস্তুভিটাহীন ও ভবঘুরে ব্যক্তিরা। গাজীপুরের জয়দেবপুর ও টঙ্গী রেলস্টেশনে গেলেই দেখা মেলে বাস্তুভিটাহীন মানুষের। অনেকে শীতের কারণে রাতে না ঘুমিয়ে ঘুমাচ্ছেন দিনের বেলায়।

গাইবান্ধার পলাশবাড়ীর আয়শা সিদ্দিকা। বয়স ৬০ বছর। স্বামী ও একমাত্র ছেলেকে হারিয়েছেন অকালে। এরপর ছয় বছরের মেয়ে রানীকে নিয়ে একা হয়ে পড়েন। সংসার চালাতে কাজ শুরু করেন মানুষের খেতখামারে। মেয়ে বড় হয়, বিয়েও দেন। আরও একা হয়ে পড়েন আয়শা। এর মধ্যে মানুষের বাড়িতে কাজও বন্ধ হয়ে যায় তাঁর। পড়েন চরম বিপাকে। সেই থেকে দিন কাটতে শুরু করে কোনো রকমে খেয়ে না–খেয়ে। এলাকার একজন আয়শাকে পরামর্শ দেন রাজধানী ঢাকায় এসে কাজ খোঁজার। আয়শাও তাঁর কথা মেনে ঢাকায় পাড়ি জমান কাজের সন্ধানে। কিন্তু বয়সের ভার আর শারীরিক অক্ষমতায় কোথাও কাজ মিলছিল না। এরপর ঘটনাক্রমে ঠাঁই হয় গাজীপুরের জয়দেবপুর রেলস্টেশনে, খোলা আকাশের নিচে। সেই থেকে এখানেই চলছে থাকা-খাওয়া-ঘুম। জীবন চলে ভিক্ষা করে।

খোলা আকাশের নিচে হলেও আয়শার দিন হয়তো ভালোই কাটছিল। কিন্তু তীব্র শীত তাঁর কেড়ে নিয়েছে ঘুম, জীবনকে করে তুলেছে অভিশপ্ত। কখনো দিনভর ঘন কুয়াশা, কখনো সকালের হিম বাতাস—এর মাঝেই চরম কষ্টে এবার শীত পার করছেন আয়শা। অর্থাভাবে নেই শীতের গরম কাপড়, বিছানা। রাত কাটে বসে, জেগে থেকে।

আয়শার মতো এমন অসংখ্য বাস্তুভিটাহীন লোকের বাস গাজীপুর নগরের বিভিন্ন এলাকায়। বিশেষ করে জয়দেবপুর রেলস্টেশন ও টঙ্গী রেলস্টেশনে তাঁদের সবচেয়ে বেশি দেখা মেলে। বছরের অন্য সময়টা কষ্টেসৃষ্টে কাটিয়ে দিতে পারলেও শীতে তাঁদের জীবনে নেমে আসে অভিশাপ। শীতের প্রতিটি সকাল, রাত কাটে খুব কষ্টে, অসহ্য যন্ত্রণায়। একে তো নেই কম্বল, শীতের কাপড়, তার ওপর সকালের ঘন কুয়াশা আর ঠান্ডা বাতাস তাঁদের কষ্ট বাড়িয়ে তোলে কয়েক গুণ। এসব হতদরিদ্র উদ্বাস্তু মানুষকে দেখার কেউ নেই। তাঁদের জন্য নেই কোনো ধরনের সরকারি উদ্যোগও।

১৭ জানুয়ারি বিকেলে জয়দেবপুর রেলস্টেশনে কথা হয় বৃদ্ধ আয়শা সিদ্দিকার সঙ্গে। তিনি থাকেন প্ল্যাটফর্মের পশ্চিম পাশে একটি পরিত্যক্ত রেললাইনের ওপর বিছানা পেতে। তিনি বলেন, ‘শীতের যন্ত্রণায় রাতে ঘুমাতে পারি না। বিছানার নিচে মাটি থেকে ঠান্ডা ওঠে। আর ওপর থেকে কুয়াশা পড়ে কাপড় ভিজে যায়। এ কারণে রাতের অধিকাংশ সময় জেগে কাটাই।’ আয়শা বলেন, গরমে খুব বেশি সমস্যা না হলেও শীত এলে যন্ত্রণা বেড়ে যায়। অন্যান্যবার অনেকেই এসে শীতের কম্বল দিয়ে যায়। কিন্তু এবার কেউ তা দেয়নি।

১৮ জানুয়ারি রাত ৯টার দিকে স্টেশন ঘুরে দেখা যায়, স্টেশনের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছেন ২০ থেকে ২৫ জন উদ্বাস্তু। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন নারী-পুরুষ–শিশু। কেউ প্ল্যাটফর্মের ওপর, কেউ পদচারী–সেতুতে, কেউবা প্ল্যাটফর্মের পাশেই পরিত্যক্ত রেললাইনের ওপর শুয়ে-বসে রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেরই গায়ে শীতের কাপড় ছিল না, শীতে কাঁপছিলেন। ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মের টিকিট কাউন্টার ও আশপাশে ১০-১৫ জন নারী-পুরুষকে বসে থাকতে দেখা যায়। তাঁদের সবার কাছেই একটি করে পাতলা কম্বল, বিছানার জন্য একটি পাতলা কাঁথা ও একটি বালিশ দেখা গেল। তাঁরা সবাই স্টেশন ফাঁকা হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

একই চিত্র দেখা যায় টঙ্গী রেলস্টেশনেও। ২০ জানুয়ারি সকালে টঙ্গী স্টেশনে দেখা যায়, স্টেশনের ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মের দক্ষিণ পাশে ঘাসের ওপর লাইন ধরে শুয়ে আছেন কয়েকজন ভবঘুরে। তাঁদের কারও গায়ে পাতলা কম্বল, আবার কেউ একটি পাতলা কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছেন। তাঁদের মধ্যে মো. হারুন নামের এক কিশোর জানান, শীতের কারণে রাতে  তাঁদের ভালো ঘুম হয় না। এ কারণে সকালের রোদে ঘুমাচ্ছেন।

যোগাযোগ করা হলে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় দুস্থ, গরিব ও অসহায় ব্যক্তিদের মাঝে শীতবস্ত্র পৌঁছে দিয়েছি। আমাদের কাছে আরও কিছু শীতবস্ত্র রয়েছে। আমরা সেগুলো দুস্থ ব্যক্তিদের মাঝে বিলিয়ে দেব।’