'গেস্টরুম' নির্যাতন চলছে, ঢাবি প্রশাসন নিষ্ক্রিয়

চার ছাত্রকে নির্যাতনের প্রতিবাদে শিক্ষার্থী মুকিমুল হক চৌধুরীর অবস্থান। গতকাল রাজু ভাস্কর্যের সামনে।  ছবি: প্রথম আলো
চার ছাত্রকে নির্যাতনের প্রতিবাদে শিক্ষার্থী মুকিমুল হক চৌধুরীর অবস্থান। গতকাল রাজু ভাস্কর্যের সামনে। ছবি: প্রথম আলো

বিভিন্ন অজুহাতে নির্যাতন বা খবরদারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নতুন কোনো ঘটনা নয়। সব সময় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের চাওয়া-পাওয়া। এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রশ্রয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে এ বক্তব্য পাওয়া গেছে।

শিক্ষার্থীরা জানান, গত মঙ্গলবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে যে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, সেটা ধারাবাহিক পরিস্থিতির অংশ। ওই রাতে চার ছাত্রকে ছাত্রশিবিরের কর্মী সন্দেহে ব্যাপক মারধর করেন হল শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। রাতে প্রায় আড়াই ঘণ্টা নির্যাতনের পর হল প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিমের মাধ্যমে তাঁদের শাহবাগ থানায় সোপর্দ করা হয়। পরদিন দুপুরে পুলিশ তাঁদের ছেড়ে দেয়। ছাড়া পেয়ে বিচারের দাবিতে বিকেল পাঁচটা থেকে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে অবস্থান শুরু করেন মারধরের শিকার ছাত্র মুকিমুল হক চৌধুরী। তিনি চিকিৎসার জন্য গতকাল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। হামলার শিকার অন্য তিন ছাত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।

সন্ত্রাসবিরোধী ছাত্র ঐক্যের অন্যতম নেতা হাসান আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, মারধরে আহত মুকিমুলকে পরিবারের সদস্যরা একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন। সুস্থ হলে আবার আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।

নির্যাতনের চক্র
প্রতিবছর জানুয়ারির শুরুতে রাত ১১টা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একটু পরপর তরুণদের ছোট-বড় দল চোখে পড়ে। ‘গেস্টরুম’ থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বাইরে ঘুরতে পাঠানো এসব তরুণ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থীদের দেখামাত্র সালাম দেওয়া, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য থাকা ইত্যাদি শর্ত সাপেক্ষে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোর গণরুমে থাকেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসনসংকটের ফলাফল গণরুমব্যবস্থা। এক কক্ষে গাদাগাদি করে থাকেন অনেক শিক্ষার্থী। হলে থাকতে হলে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নিয়ন্ত্রণে থাকা গণরুমগুলোতে উঠতেই হয়, বিনিময়ে যেতে হয় ওই সংগঠনের নিয়মিত রাজনৈতিক কর্মসূচিতে। এখন গণরুমের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক ছাত্রলীগ। ডাকসু নির্বাচনের সময় সব প্যানেলের ইশতেহারে গণরুমব্যবস্থার সমাধানের আশ্বাস থাকলেও এ ব্যবস্থা এখনো বহাল।

>

চার ছাত্রকে মারধর। বিক্ষোভে সরব ক্যাম্পাস। আহত মুকিমুল প্রতিবাদ কর্মসূচি থেকে হাসপাতালে।

মঙ্গলবার রাত দেড়টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় কথা হলো প্রথম বর্ষের কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তাঁরা বললেন, ‘বড় ভাইয়েরা’ গেস্টরুম থেকে তাঁদের ঘুরতে পাঠিয়েছেন। জানালেন ‘গেস্টরুম’-এর দুর্ব্যবহার ও পড়তে এসে হতাশ হওয়ার গল্প।

প্রথম বর্ষে যাঁরা এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হন, দ্বিতীয় বর্ষে তাঁদেরই অনেকে আবার অবতীর্ণ হন ‘বড় ভাই’য়ে। তাঁরা কাউকে শিবির-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে পেটান, কাউকে পেটান কর্মসূচিতে না যাওয়ার অভিযোগে, কাউকে আবার পেটান অবাধ্যতার অজুহাতে। তাঁদের কোনো বিচার হয় না। এভাবেই বছরের পর বছর ধরে নির্যাতনের এই চক্র চলে আসছে। এ ক্ষেত্রে অনেকটা নির্বিকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী অবশ্য বললেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যবস্থা নেয়। তবে শুধু ছাত্রলীগের ওপর দোষ চাপাতে নারাজ তিনি। খারাপ সংস্কৃতির পরিবর্তনে মানসিকতার পরিবর্তন দরকার বলে মনে করেন তিনি।

পেটানো হলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না
মঙ্গলবার রাতে শিবির-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে চার ছাত্রকে পিটিয়ে পুলিশে দিয়েছে ছাত্রলীগ। কিন্তু কোনো লিখিত অভিযোগ না পাওয়ায় পুলিশ তাঁদের ছেড়ে দেয়। এমন ঘটনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এটিই প্রথম নয়। মূলত ছাত্রলীগের ভিন্নমতাবলম্বী হলে, এমনকি কারও সঙ্গে ব্যক্তিগত শত্রুতা থাকলেও তাঁকে ‘শিবির কর্মী’ আখ্যা দিয়ে মারধরের ঘটনার নজির রয়েছে।

২০১৫ সালের ২ আগস্ট রাতে বিজয় একাত্তর হলে আন্তর্জাতিক ব্যবসায় (আইবি) বিভাগের শিক্ষার্থী হোসাইন মিয়াকে ছাত্রশিবিরের কর্মী আখ্যা দিয়ে বেধড়ক মারধর করেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। অথচ হোসাইন ছিলেন ছাত্রলীগেরই কর্মী। ওই ঘটনায় হলের তদন্ত কমিটি হল শাখা ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছিল। কিন্তু সাড়ে তিন বছর পার হলেও সেই সুপারিশের বাস্তবায়ন হয়নি।

২০১৭ সালের ১৩ আগস্ট রাতে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে প্রথম বর্ষের ছাত্র মনিরুল ইসলামকে একই অপবাদে পিটিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও রাতেই হলে ফিরিয়ে আনা হয়। পরে জানা যায়, মনির ছাত্রশিবিরের কেউ নন, ছাত্রলীগের কর্মী। তাঁর পরিবারও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।

ওই ঘটনার চার দিন পর হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের পাঁচ শিক্ষার্থীকে শিবির কর্মী সন্দেহে মারধর করে পুলিশে দেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। পরে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান জানান, শিবির-সম্পৃক্ততার কোনো প্রমাণ না পাওয়ায় তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

নির্যাতনের ঘটনা আরও আছে
ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগের প্যানেলের বাইরে থেকে প্রার্থী হওয়ার জের ধরে গত বছরের ১ এপ্রিল রাতে এসএম হলে মাস্টার্সের ছাত্র ফরিদ হাসানকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করেন হল শাখা ছাত্রলীগ ও হল সংসদের নেতারা। বিচার চেয়ে পরদিন প্রাধ্যক্ষের কাছে স্মারকলিপি দিতে গিয়ে ছাত্রলীগের হাতে লাঞ্ছিত হন ডাকসুর ভিপি নুরুল হক। লাঞ্ছনা ও মারধরের শিকার হন কয়েকজন নারীনেত্রীও।

ঘটনা তদন্ত করে হল প্রশাসন ৭ মে উপাচার্যের কাছে প্রতিবেদন দেয়। এরপর ২৮ মে শৃঙ্খলা বোর্ডের সভায় প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করে সুপারিশ দেওয়ার জন্য চারজন প্রাধ্যক্ষকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ঘটনার এক বছর হতে চললেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। শৃঙ্খলা বোর্ডের সদস্যসচিব ও প্রক্টর গোলাম রব্বানী বলেন, প্রতিবেদনটি শৃঙ্খলা বোর্ডে পাস হয়েছে। পরবর্তী সিন্ডিকেট সভায় উঠবে।

সহপাঠীর কাছ থেকে ক্যালকুলেটর ধার নেওয়া নিয়ে ২০১৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে (এসএম হল) ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মারধরের শিকার হন এহসান রফিক। তিনি দুর্যোগবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তাঁকে হলের একটি কক্ষে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। এতে এহসানের একটি চোখের কর্নিয়া গুরুতর জখম হয়। তাঁর কপাল ও নাক ফেটে যায়।

নির্যাতনের ঘটনায় এসএম হল শাখা ছাত্রলীগের সহসম্পাদক ওমর ফারুককে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এ ছাড়া শাখা ছাত্রলীগের প্রশিক্ষণবিষয়ক উপসম্পাদক মেহেদী হাসান ওরফে হিমেল, সহসম্পাদক রুহুল আমিন ব্যাপারী, সহসম্পাদক ফারদিন আহমেদ, কার্যকরী সদস্য আহসান উল্লাহ ও সামিউল হককে দুই বছর এবং সহসভাপতি আরিফুল ইসলামকে এক বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে তাঁদের ছয়জনেরই সাজার মেয়াদ কমিয়ে দিয়েছে প্রশাসন। স্থায়ীভাবে বহিষ্কৃত ওমর ফারুকের সাজা কমে হয়েছে দুই বছর আর পাঁচজনের দুই বছরের বহিষ্কারাদেশ কমে হয়েছে এক বছর।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘অপরাধের সত্যতা পাওয়া গেলে ছাত্রলীগ অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। তবু যদি কোনো ত্রুটি থেকে থাকে, ভবিষ্যতে সেগুলো যাতে না হয়, সেই চেষ্টা থাকবে।’

প্রতিবাদ-বিক্ষোভ
মঙ্গলবারের ঘটনার প্রতিবাদে চার দফা দাবি এবং ২০১৮ সালের ২৩ জানুয়ারি নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহসভাপতি (ভিপি) নুরুল হকের নেতৃত্বাধীন ১২ ছাত্রসংগঠনের জোট সন্ত্রাসবিরোধী ছাত্র ঐক্য গতকাল ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে। রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে সমাবেশে ভিপি নুরুল হক অভিযোগ করে বলেন, শিক্ষার্থীদের মুক্তভাবে মতপ্রকাশ ও মুক্ত জ্ঞানচর্চার পথে ছাত্রলীগ প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সমাবেশে ভিপি নুরুল চার দফা দাবি তুলে ধরেন। এগুলো হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানীর পদত্যাগ, প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের আবাসিক হলে বৈধ সিট দেওয়া ও অছাত্র-বহিরাগত বিতাড়ন করে হলগুলোতে ছাত্রলীগের সন্ত্রাস-দখলদারি বন্ধ করা, ২২ ডিসেম্বর ডাকসু ভবনে ছাত্রলীগ-মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের হামলা-ভাঙচুর ও জহুরুল হক হলে নির্যাতনের ঘটনায় জড়িতদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবন বহিষ্কার এবং নিরাপদ ও গণতান্ত্রিক ক্যাম্পাস বিনির্মাণ।

পদত্যাগের দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে ভিপি নুরুলকে ‘দায়িত্বশীল আচরণ’ করার পরামর্শ দেন প্রক্টর গোলাম রব্বানী।

বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের ৩৫ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গতকাল দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় আয়োজিত ছাত্র সমাবেশেও চার ছাত্রকে নির্যাতনের ঘটনার প্রতিবাদ জানানো হয়। সেখানে আলোচনায় অংশ নিয়ে ডাকসু ভিপি অভিযোগ করেন, ভিন্নমত দমনের লক্ষ্যে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন পরিকল্পিতভাবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করছে।

সমাবেশে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকিসহ ছাত্র ফেডারেশনের সাবেক ও বর্তমান নেতা-কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।